ইউরোপে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট লিবিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:১৪:৫৮,অপরাহ্ন ৩০ মে ২০২০ | সংবাদটি ৮৭৮ বার পঠিত
তৃতীয় বাঙলা ডেস্কঃ
ইউরোপে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট এখন ভূমধ্যসাগর তীরের দেশ লিবিয়া। ইউরোপে মানব পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশটি।
মানব পাচারকারী চক্র বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যুবকদের লিবিয়ায় নিয়ে থাকে। এরপর তাদের পণবন্দী করে পরিবারের কাছ থেকে ৭-৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করার পর ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব অভিবাসীর সলিল সমাধি হয় সাগরে। আবার অনেকের জীবন যায় মানব পাচারকারীদের নির্যাতন-নির্মমতায়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচারকারীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশি ও ৪ জন আফ্রিকান নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় আহত হন আরও কমপক্ষে ১১ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রের তথ্যানুযায়ী, দেশজুড়ে থাকা পাচারকারী চক্রের সদস্যরা ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে লোক সংগ্রহ করে। তারপর সেসব লোককে সড়ক-বিমানপথ মিলিয়ে তিনটি রুটে লিবিয়ায় পাঠায়। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিশিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাঠায়। ৭ থকে ৮ লাখ টাকার অর্থের বিনিময়ে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় সবই এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয় বলে জানতে পারে র্যাব। ইউরোপে পাচারে চক্রটি তিনটি রুট ব্যবহার করে থাকে। রুটগুলো হলো বাংলাদেশ-ইস্তাম্বুল-লিবিয়া, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা (৪-৫ দিন অবস্থান)-ইস্তাম্বুল (ট্রানজিট)-লিবিয়া এবং বাংলাদেশ-দুবাই (৭-৮ দিন অবস্থান)-আম্মান (জর্ডান) (ট্রানজিট)-বেনগাজি (লিবিয়া)-ত্রিপলি (লিবিয়া)। এক্ষেত্রে তারা সড়ক ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়া পৌঁছিয়ে থাকে। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিশিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাচার করে থাকে চক্রটি।
জানা গেছে, মূলত বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার লোকজন এভাবে ইউরোপে যায়। এই এলাকাগুলো ঘিরেই শক্তিশালী দালাল চক্র গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে। স্থানীয় দালাল চক্রের পাশাপাশি লিবিয়া বা অন্য দেশে আন্তর্জাতিক মানব-পাচারকারী চক্রগুলো যোগসাজশ করে বাংলাদেশ থেকে লোভনীয় অফার দিয়ে ইউরোপ যাত্রায় শিক্ষিত যুবকদের লিবিয়া বা ভূমধ্যসাগর তীরের আশপাশের দেশে নিয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সেখানে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে বড় মাপের মুক্তিপণ আদায় করে। তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। অনেকে মানব পাচারকারীদের নির্যাতনেই মারা যান, বেঁচে থাকাদের ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে পাঠানোর কথা বলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকায় তুলে দেওয়া হয়। যাদের অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটে সাগরে, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর হয়। গত বছরের ৯ মে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের নৌকাডুবিতে প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ জন নিখোঁজ হন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ৩৯ জন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে প্রায় এক দশক ধরে মানব পাচারকারী চক্র সেখানে সক্রিয়। তারা ইউরোপে লোক পাঠানোর নামে একেকজনের কাছ থেকে গড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা নিচ্ছে। ভূমধ্যসাগরের কাছে লিবিয়ার বিভিন্ন সীমান্তে ক্যাম্প করে তারা লোকজনকে পণবন্দী করে ছোট ছোট নৌকায় করে ইউরোপে পাঠাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো গত পাঁচ বছর ধরেই বন্ধ। তারপরেও কী করে এত লোক বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যাচ্ছে- সেই ঘটনার তদন্ত করা উচিত। শরিফুল হাসান জানান, গত কয়েক বছরে আইওএম ও ব্র্যাকের প্রত্যাশা প্রকল্প থেকে ৩৫০ লিবিয়াফেরত বাংলাদশিকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ফিরে আসা বাংলাদেশিরা পণবন্দী ও মুক্তিপণ আদায়সহ নিপীড়নের নানা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমেও এসব কথা উঠে এসেছে। এভাবে যেন আর কোনো অভিবাসী সেখানে প্রাণ না হারায়- আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জোর ভূমিকা পালন করতে হবে।