তৃতীয় বাঙলা ডেস্কঃ
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার বিরুদ্ধে তিউনিসিয়ায় থাকা শিশুসহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রতি সংস্থাটির আচরণ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগের কথা প্রকাশ হওয়ার পর এই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তিউনিসিয়াভিত্তিক এনজিও ফোরাম তিউনিসিয়েন পৌর লেস ড্রয়েটস ইকোনমিক্স এট সোসিয়াক্স (এফটিডিইএস) আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। অভিবাসীরা অভিযোগ করে আসছেন, সাগর থেকে উদ্ধার হওয়ার পর আইওএম কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা তাদের দেশে ফেরার জন্য চাপ দিচ্ছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এখবর জানিয়েছে।
৬৪ জন বাংলাদেশি অভিবাসী জানিয়েছেন, আইওএম তাদের স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার জন্য একটি নথিতে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যথায় তাদের গ্রেফতারের হুমকিতে থাকতে হবে। তারা আরও বলছেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিকরা তাদের সতর্ক করে বলেছেন যে, তারা যদি স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার নথিতে স্বাক্ষর না করেন তাহলে তারা অঙ্গপাচারের শিকার হতে পারেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, অভিবাসীদের প্রতি আইওএম তিউনিসিয়ার আচরণের কারণে অভিবাসীদের নেওয়া সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এফটিডিইএস আইওএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। অভিবাসীদের সাক্ষে সামঞ্জস্য ছিল এবং সবাই আইওএমের পক্ষ থেকে অসদাচরণের অভিযোগ করেছেন।
মে মাসে ম্যারিডাইব ৬০১ নামের একটি জাহাজ থেকে এই অভিবাসীদের উদ্ধার করা হয়। কোনও ইউরোপীয় দেশ তাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সাগরে তারা প্রায় তিন সপ্তাহ আটকে পড়েছিলেন।
এফটিডিইএস জানায়, অভিবাসীদের মতে, আইওএম কর্মীরা তাদের বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার বিষয়ে সাক্ষাৎকারে প্রচণ্ড মানোসিক চাপ দিয়েছে। তারা আরও জানিয়েছে, যখন ওই নথিতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন মানোসিক আরও বাড়ানো হয়। অভিবাসীরা বলেছেন, প্রাথমিক এসব সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বা ইউনিসেফের কোনও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। তারা জানেন না যে, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে কিনা। এছাড়া তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য কোনও প্রকার চাপ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে আইওএম। সংস্থাটি দাবি করেছে, তারা শুধু অভিবাসীদের নথিপত্রগুলো বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ভাষায় তারা বুঝতে পারে। অভিবাসীদের তিউনিসিয়ায় থাকা ও আশ্রয় চাওয়ার অধিকারসহ সব ধরনের বিকল্পের কথা জানানো হয়েছে।
এই বাংলাদেশিদের উদ্ধার করা হয়েছিল ৭৫ জনের সঙ্গে। এদের অর্ধেকই অভিভাবকহীন শিশু। সাগরে ১৯ দিন থাকার পর তাদের তিউনিসিয়ার জারজিসে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর রেড ক্রিসেন্টের একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্রে তাদের নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে
তবে দ্য গার্ডিয়ানকে সাক্ষাৎকার দেওয়া ৯ অভিবাসী জানিয়েছেন, তারা মনে করেন আইওএম সব বাংলাদেশিকে নৌকায় থাকার সময় ও পরে নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য মানোসিক চাপ দিয়ে আসছে।
এক অভিবাসী বলেন, আইওএম আমাদের একটি কাগজ দেয়। এতে বলা হয়েছে, কেউ আমাদের ফেরত যাওয়ার জন্য জোর করতে পারবে না। তারা আমাদের বলেছে তিউনিসিয়া পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করবে এবং তারা জানে না কখন মুক্তি দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ও তিউনিসিয়া সরকার কোনও সহযোগিতা করছে। আমরা এখানে থাকতে চাই।
আরেক অভিবাসী বলেন, প্রতিদিন তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারা জানে আমরা ফেরত যেতে চাই না। তবু তারা আমাদের জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে। তারা ফরাসি ভাষায় একটি কাগজে সাক্ষর করতে বলেছে। কিন্তু আমি ফরাসি ভাষা জানি না। তারা আমাকে কাগজে সাক্ষর করে বাংলাদেশে ফেরত যেতে বলছে। কিন্তু আমি তাতে সাক্ষর করিনি। আইওএম ওই কাগজের কোনও ভাষান্তর আমাদের জানায়নি।
অল্প মাত্রায় ইংরেজি জানা এক ব্যক্তিকে ভাষান্তর করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি জানান, ওই সময় নাবালক, ইউএনএইচসিআর বা রাজনৈতিক আশ্রয় সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা ছিল না। তারা আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছে। তারা আমাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়। লোকজন কাঁদতে শুরু করে। ফেরত যাওয়ার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভালো।
তিউনিসিয়ার দায়িত্বে থাকা ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাসের এক মুখপাত্র জানান, এই বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে পারছেন না। কিন্তু দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবগত এবং অভিযোগটি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে।
মুখপাত্র আরও জানান, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। দূতাবাসের পক্ষ থেকে নিজেরা তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, যদি তা ঘটে তাহলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিযোগ খতিয়ে দেখবে। এটা মাত্র শুরু। এই বিষয়ে আমরা আপনাদের অবহিত করব। আমরা জানি এই টিমে কারা কারা ছিল এবং কে মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছে।
বাংলাদেশি অভিবাসীরা দ্য গার্ডিয়ানকে বেশ কয়েকবার জানিয়েছেন যে, তারা যদি দেশে ফিরে যান তাহলে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। অনেকে লিবিয়া পৌঁছাতে টাকা-পয়সা ধার করেছেন এবং তাদের আশঙ্কা দেশে ফিরে গেলে তারা হুমকি ও নির্যাতনের মুখে পড়বেন।
বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া এড়াতে তিউনিসিয়ার একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এক কিশোর পুনরায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাকে বহনকারী নৌকা আটক করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে ওই কিশোর এখন লিবিয়ার কোনও একটি আটককেন্দ্রে রয়েচে।
বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশিদের এক আত্মীয় জানান, বাংলাদেশে অনেক মানুষ তাকে হত্যা করতে চায়। নিজের সব টাকা-পয়সা দিয়ে লিবিয়া গমন করে এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে। লিবিয়াতেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে সেখান থেকে পালায়। সে ইউরোপে যেতে চায়।
আইওএম-র এক মুখপাত্র লিওনার্দ ডোয়েল জানান, যারা দেশে ফিরতে চেয়েছে তাদের পরামর্শ ও নথিপত্র তাদের বুঝতে পারার মতো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আশ্রয়সহ সব ধরনের বিকল্পের কথা অভিবাসীদের জানিয়েছে আইওএম। সংস্থার কর্মীরা তিউনিসিয়ায় যারা আশ্রয়ের আবেদনে আগ্রহী নয় তাদেরকে বসবাসের অনুমতির প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু যারা থেকে যেতে চেয়েছে তাদেরকে বলা হয়েছে তিউনিসিয়া থাকতে চাইলে অবশ্যই বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে।
লিওনার্দ বলেন, যেসব অভিবাসীরা থেকে যেতে চেয়েছেন তাদের পাসপোর্ট নেই। তিউনিসিয়ায় তাদের পক্ষে পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব না। তাই আইওএম কর্মীরা এই পরিস্থিতির ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, অভিবাসীদের সব ধরনের তথ্য জানায় আইওএম যাতে করে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এফটিডিইএস নিশ্চিত করেছে, স্বেচ্ছায় দেশে ফেরত যাওয়ার কাগজে সাক্ষর না করা ও তিউনিসিয়ায় থাকতে আগ্রহী চার বাংলাদেশিকে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করেছে।