ফ্রান্সে বাঙালিদের মাঝে আলো ছড়াচ্ছে ফ্রঁসে আভেক রাব্বানী অফিওরা
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৩৬:৫১,অপরাহ্ন ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ১৮৬৪ বার পঠিত
শাবুল আহমেদ
ফ্রান্সে বাঙালি প্রবাসীদের ফরাসি ভাষার শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন সেবামূলক সহযোগিতার একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান ফ্রঁসে আভেক রাব্বানী; বর্তমানে এটি অফিওরা নামে পরিচিত।
প্যারিসের ওভারভিলাতে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৮ বছর ধরে ফরাসি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
অনলাইনে ফরাসি ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে ২০১২ সনের ১৯ মে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় খুব অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালক রাব্বানী খান কৌশিক ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মাঝে আশাজাগানিয়া সাড়া দেখেন। পরবর্তীতে কিছু সংখ্যক অনলাইন শিক্ষার্থী রাব্বানীকে স্কুল করার প্রস্তাব দেন। ফলশ্রুতিতে একটি টেক্সিফোনের ছোট কামরা থেকে শুরু হয় আজকের এই যাত্রার প্রথম সোপান।
ফ্রান্সে সফল ব্যাবসায়ী এবং কমিনিউটি ব্যক্তিত্ব ফারুক খান এবং ইয়াসমিন খানমের সন্তান রাব্বানী। পুরো নাম রাব্বানী খান কৌশিক। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে গাজীপুরে। বাংলাদেশে ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন মায়ের সঙ্গে তিনি চলে আসেন ফ্রান্সে। বাবা আগে থেকেই ফ্রান্সে বসবাস করতেন। সেই সুবাদে মূলত তার ফ্রান্সে আসা হয়।
তিনি কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স প্রথম বর্ষ শেষ করে ফ্রান্সের স্বনামধন্য প্যারিস-২ আসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
এক দশকেরও কম সময়ে তিনি একজন উদ্যোক্তা এবং অন্যতম প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে ওঠেন রাব্বানী।
ছোট্র একটি ট্যাক্সিফোন থেকে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দু’তল ভবনে বিশাল অংশ জুড়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম।
সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া এই প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন সেবা দিয়ে যাচ্ছে গড়ে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষকে। ৯০% মানুষই প্রতিষ্ঠানের সামাজিক কাজ বা বিনামূল্যে সেবা পেয়ে থাকছেন। বর্তমানে শুধু বাংলাদেশী নয়, অন্যান্য কমিউনিটির মানুষও এই প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা পেয়ে থাকছেন।
৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রারাম্ভ এই স্কুলের বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা আড়াই শতাধিক। সপ্তাহে ৬ দিন বিভিন্ন শিক্ষাপর্বে এসব শিক্ষার্থীরা পড়ছেন; রয়েছে বিনামূল্য ভাষা শিক্ষার সুযোগ।
কেবল ফ্রান্সে নয় ইউরোপের অনেক দেশেই রাব্বানী এখন একটি পরিচিত নাম। তার ভিডিও দেখে ভাষা শিখছে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। অভিবাসনসহ বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে প্রায় লাখো মানুষের কাছে।
গেল বছর রাব্বানীর সাথে পরামর্শের মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার মানুষ সহযোগিতা পেয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ২০ হাজারেও বেশি মানুষ এই প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা গ্রহণ করেছেন।
এ ছাড়া সপ্তাহে ৬ দিন সামাজিক অধিকার বিষয়ক সিএমইউসি, এডমেডিকেল, সলিদেরটি দ্যা ট্রান্সপোর্ট, লোজেমেন্থ স্যোস্যাল ইত্যাদি কাজে সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। এই বিষয়ে রাব্বানী একটি দল গঠন করেছেন যারা না থাকলে এত বড় প্রতিষ্ঠান এভাবে এগিয়ে যেত না।
ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি আইনি পরামর্শ, উকিল নিয়োগ, অনুবাদ, দোভাষীসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানের অফিসে এসে কাজ করছেন নামি দামি ফরাসি আইনজীবিগণ।
ফ্রঁসে আভেক রাব্বানী (অফিওরা) শুধু নিজেরাই এগিয়ে যাচ্ছে না, আরও একাধিক সংগঠন ও এসোসিয়েশনকে নিয়মিত সহায়তা করে যাচ্ছে।
একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে ফ্রান্সে রাব্বানী’র আলাদা সুখ্যাতি রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য মানুষ কর্মসংস্থান পেয়েছেন। বর্তমানে প্রায় ২৫ জন বাংলাদেশী এখানে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছেন।
ইতোমধ্যে তাঁর সাফল্যের পালকে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছেন। বর্তমানে তিনি ফ্রান্সের সুপরিচিত এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রথম বিভাগে খেলা এক মাত্র এবং প্রথম ক্লাব বাংলাদেশ ক্রিকেট ক্লাবের সহঃসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া একাধিক এসোসিয়েশনকে সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন। বিশেষ করে বিসপি ও বিসিএফ’ সূচনালগ্ন থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন তিনি।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও সমাজকর্মী রাব্বানী খান কৌশিক বলেন, এ দেশে বাঙালিদের সফলতা অর্জনের প্রধান অন্তরায় ভাষা; ভাষাগত সমস্যার কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে যাই। মূলত এই সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রয়াস নিয়েই ‘ফ্রঁসে আভেক রাব্বানী’ ভাষা শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। একই সাথে আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে ফ্রান্স বসবাসরত বাংলাদেশিদের আছে জ্ঞান; বুদ্ধি এবং সফল হওয়ার উদ্যমী মনোভাব। প্রয়োজন শুধু ভাষা শিক্ষা এবং পথ প্রদর্শন।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে ইউটিউবে মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু করি। আজ আমরা দুটো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের কার্যক্রম সম্পাদন করছি।’
ভবিষ্যতে কিভাবে সামাজিক কাজ ও সেবার ম্যান আরও বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে তাঁর নতুন কিছু পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান।
তৃতীয় বাঙলা ডট কমের সাথে আলাপকালে ২০১২ সালের পূর্বে ফ্রান্স আসা একাধিক অভিবাসি জানান- এক সময় ফ্রান্স সামান্য তথ্যের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ভাষা শেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকলেও ভাষার জটিলতার ভয়ে অনেককেই শিখতে অনাগ্রহী ছিলেন। তাঁদের মতে- রাব্বানী সেই ভয় দূর করতে সক্ষম হয়েছেন।
দীর্ঘদিন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অগ্রসর হয়ে রাব্বানী কমিনউনিটির অন্য অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছেন; অনেকেই এগিয়ে আসছেন কমিউনিটির মানুষের সেবায়।
সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন ফ্রান্সের একাধিক শহরের মেয়র ও কাউন্সিলরবৃন্দ।
পরিদর্শনকালে ওবেরভিলিয়ের মেয়র তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন- ‘রাব্বানী কোন প্রকার সরকারি সহায়তা ছাড়াই যে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছে, সেটা সাধারণত একটি দেশের সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠানের মত।’
প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন ‘আমি এটা জেনে গর্ববোধ করি যে এই প্রতিষ্ঠান আমাদের শহরে। সকল ধরণের সহায়তা প্রদান করতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত রয়েছি।’
প্রতিষ্ঠানের ভূয়সী প্রশংসা করে ফ্রান্সে বসবাসরত বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক অঙ্গণের ব্যক্তিবর্গ- এ যাত্রা অব্যাহত থাকার প্রত্যাশা জানান।
তাদের মতে- চলমান কার্যক্রমের সফলতা ও বিভিন্ন দিক অনুশীলন করে ভবিষ্যতে বাঙালিরা অনন্য উচ্চতায় আরোহন করতে পারবে।