পাশ্চ্যতের নারীরাও ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:২৬:৩৬,অপরাহ্ন ১৬ মে ২০১৯ | সংবাদটি ৭৯৬ বার পঠিত
হাসিনা আক্তার :
ডোমেস্টিক ভায়েলেন্স বলতে পরিবারের আপনজন দ্বারা নির্যাতিত হওয়াকে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি। পরিবারের একজন আরেকজনের প্রতি যে কোন ধরনের হুমকি, অপমানকর এবং সহিংসমূলক আচরণের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অধিকাংশ পুরুষ মানুষের মধ্যেই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, মহিলাদের মধ্যে যে একেবারেই নেই তা বলা যায় না। এ সমাজে এ পৃথিবীতে অনেকেই অনেকভাবে নির্যাতিত হয়, কিন্তু ক’জনের খবর আমরা রাখি? ক’জনের খবর ই-বা পত্রিকার পাতায় আসে? অনেকে তো মান সম্মানের ভয়ে মুখ খুলতে চায়না এবং মুখ খুলতে চাইলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্ন কারণে নিরুৎসাহিত করে থাকে। তবে মুখ খোলা উচিত এবং মুখ খুললেই বুঝতে পারবে সে একা নয় তার পাশে অসংখ্য মানুষ এবং সাপোর্ট সেন্টার রয়েছে তাকে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার জন্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মহিলা সংসার জীবনে ভালো হয় এবং মহিলাদের অত্যাচারের শিকার হন বাড়ির কাজের মেয়েরা। এসব অত্যাচারের চিত্র টেলিভিশন অথবা পত্রিকার পাতায় দেখলে মনে হয় আমরা যেন মধ্যযুগে বসবাস করছি । তা ছাড়া এ লেখা রেডি করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে যে সব তথ্য পেয়েছি সে সব তথ্যের জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। একদম নিচু অবস্থান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ অবস্থান পর্যন্ত নারীরা সবাই কমবেশী ডোমেস্টিক ভায়েলেন্সের শিকার। তবে পুরুষরা যে ডোমেস্টিক ভায়েলেন্সেরএর শিকার না, তা আমি বলছি না।
৯০ দশকে লন্ডনে বাঙালি কমিউনিটিতে বেশ কিছু ব্রিটিশ নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ থেকে তাদের স্বামীকে লন্ডনে নিয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ লন্ডনে ভিজিট ভিসায় এসে বিয়ে করে লিগ্যাল হয়েছেন। যারা এইভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তারা উভয়েই পরবর্তীতে ভীষণভাবে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশে বিশেষ করে সিলেটে বড় হওয়া একটি ছেলের সাথে লন্ডনে বড় হওয়া একটি মেয়ে কোনোভাবেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। যে মেয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছে সে মেয়ে কী করে সিলেটের একটি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ছেলের সাথে জীবন কাটাবে? মতের অমিল, মনের অমিল সব ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে দেখা যায় ডোমেস্টিক ভায়েলেন্সের শিকার স্বামী স্ত্রী দুজনই। এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদ, মারামারি, তারপর পুলিশ এবং শেষ পর্যন্ত সোশ্যাল সার্ভিস এর কাছে চলে যায় এই সব পারিবারিক ঝামেলা, এরপর স্বামী এন্ডআপ হয় জেলে, তারপর বিবাহ বিচ্ছেদ। বৃটিশ হোম অফিসের তথ্যনুযায়ী ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল দশ বছরে ১০ হাজার বিয়ে হয়েছে ব্রিটিশ বাঙালী কমিউনিটিতে এর মধ্যে ৯ হাজার বিয়েই ভেঙ্গে গেছে।
২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক জরিপে দেখা গেছে প্রতি তিনজন মহিলার একজন ডোমেস্টিক ভায়েলেন্সের শিকার, আর প্রতি ৪ জন পুরুষের একজন। সহিংসতা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ও অর্থনৈতিক অবস্থা যে কোনো ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। এ অবস্থা বেশীরভাগ পরিবারে দেখা যায়। অনেক সময় ভয়ংকর এবং বিপদজ্জনক রূপ ধারণ করে আতœহত্যার মধ্যে দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাদের সন্তানরা শৈশব থেকে এসবের সাক্ষী থেকে যায়। এই বাচ্চারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক সময় ভায়োলেন্সের শিকার একজন নারী বছরের পর বছর সব সহ্য করে থেকে যায়। এর কারণ হিসেবে অনেকগুলো দিক উঠে আসে, প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং শিক্ষার অভাব। থাকা এবং খাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে বলে তারা অত্যাচার মেনে নিয়ে পরিবারের সাথে দিনাতিপাত করে। এবং এ ক্ষেত্রে নিজ পারিবারিক অসচ্ছলতাও অনেকাংশে দায়ী। অনেক সময় একজন নারী একা থাকাটা সমাজে গ্রহন-যোগ্য নয় বিধায় সব অত্যাচার মেনে নেয়। তাছাড়া বিশ্বের অনেক দেশসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান পেতে হলেও পারিবারিক অবস্থানকে গুরুত্ব দেয়া হয়, সেখানে ব্রোকেন (ভাঙ্গা) ফ্যামেলীর বিষয়টিও অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়। বৃটেন অথবা আমেরিকায় কেউ যদি প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী হতে হয় তাহলে তার সুন্দর পরিবার থাকতে হবে। এটি অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লৌহ মানবী মার্গারেট থেচারের অটোবায়োগ্রাফী যদি আমার পাঠকদের মধ্যে কেউ পড়ে থাকেন তাহলে লক্ষ্য করবেন থেচার লিখেছেন, তিনি রাষ্ট্রের কাজ ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রায় ২০ ঘন্টা করতেন, বাকী ৪ ঘন্টা তিনি ঘুমাতেন। পরিবারকে তিনি সময় দিতে পারেননি। প্রথম অবস্থায় স্বামী ডেনিস তাকে সহযোগিতা করেছেন অনেক। থেচারের উন্নতীর পিছনে স্বামী ডেনিসের অবদান রয়েছে প্রচুর। একদিন মেয়ে ক্যরল থেচার বাবা ডেনিসকে বিচার দিলেন যে, মায়ের সাথে দেখা করতে পারছেননা। তাকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। এ থেকেই থেচারের স্বামীর সাথে মনো বিবাদের শুরু। ডেনিস সরকারী বাসভবন ১০ নং ডাউনিং ষ্ট্রীটে বসবাস করতেননা। তিনি তার নিজস্ব বাড়ীতে বসবাস করতেন। একদিন ডেনিস ডাকলেন স্ত্রী মার্গারেট থেচারকে, জিজ্ঞ্যাস করলেন মেয়ে দেখা করতে পারছেনা কেন? থেচার বলেছিলেন রাষ্ট্রের কাজে ব্যস্ত থাকি। ডেনিস বলেছিলেন, রাষ্ট্রের মা হতে তার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু সবার আগে তো ক্যারল খেচারের মা হতে হবে। থেচার বিষয়টি খুব একটা পাত্তা দিতে চাননি। ডেনিস যে রাগ করছেন এটা থেচার বুঝতেই পারেননি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ¦ দেখা দিলে থেচারকে তালাকের হুমকি দিয়েছিলেন ডেনিস। এবং সেটি সলিসিটর পর্যন্ত একবার নয় দুবার নয় তিনবার গড়িয়েছিল। পরবর্তীতে পারিবারিক বন্ধুদের হস্তক্ষেপে সম্পর্ক ঠিকে যায়।
রবিন রিহানা ফেন্টি হচ্ছেন, গায়িকা, অভিনেত্রী, ডিপ্লোমেট । তিনি ভেনেটি ফেয়ারের সাথে সাক্ষাতকারে বর্নণা করেছিলেন, কিভাবে তার প্রেমিক গায়ক ক্রিস ব্রাউন তাকে গাড়িতে লাঞ্চিত করে রাস্তার পাশে রেখে গিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, তার বিশ্বাস অনেক নারী এবং অল্প বয়সী মেয়েরা এসব অত্যাচারের স্বীকার এখনো। মিস এম্বার হেয়ার ও হচ্ছেন একজন অভিনেত্রী । তার সাথে জমিডেফের ডিভোর্স হয় ২০১৬ ইংরেজীতে, তিনি তার বক্তেব্যে বলেছিলেন বিয়ের সময় তাকে মানসিক এবং শারীররিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি অত্যাচারিত নারীদের উদ্দেশে বলেছেন, বন্ধ দরজার ভিতরে আপনি একা, আপনি মনে সাহস রাখুন এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন, দেখবেন আপনি একা নন আপনার পাশে অনেকে আছে এবং এই বন্ধ দরজা আপনি একদিন ভাংতে পারবেন। মিস চার্লাইজ থেরন হচ্ছেন অভিনেত্রী এবং পরিচালক। তিনি ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারের সক্রিয় প্রচারক। তিনি ২০১৭ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে এক সাক্ষাতকারে বর্ণনা করেছিলেন তার শৈসবের কথা। দক্ষিন আফ্রিকায় তার মা এবং মদ্যপায়ি বাবার সাথে বসবাস করতো। তিনি সাক্ষী তার বাবা দ্বারা মায়ের অত্যাচারের, শেষ পর্যন্ত তার মা নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। তখন চার্লাইজ থেরনের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর।
ডোমেস্টিক ভায়লেন্স যে কারো ক্ষেত্রে হতে পারে উঁচু- নিচ,ু ধনী-দরিদ্র যে কেউ এর শিকার হতে পারে। বিশ্বের যেকোন দেশে একজন আরেকজনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললে সে অনেকভাবেই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হতে পারে । এই ইস্যু নিয়ে যত বেশি আলোচনা, সভা সমিতি , সেমিনারের মাধ্যমে জনসচেনতা বাড়ানো হবে ততই মানুষ তার অধিকার এবং মর্যাদা আদায়ে সচেষ্ট হবে। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। সুতরাং পরিবার এবং সমাজের কথা না ভেবে নিজের অধিকার এবং সম্মানের কথা চিন্তা করতে হবে সবার আগে। তবে সুস্থ সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য হুমকি – ধামকি, অন্যায় – অত্যাচার থেকে দূরে থেকে একে অন্যের প্রতি প্রেম ভালবাসার মাধ্যমে বেঁচে থাকাই সবার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। যেটি সম্প্রতি প্রিন্স হ্যারি ও ম্যগানের বিয়েতে আমেরিকান বিশপস মাইকেল ক্যারি বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন শুধু লাভ লাভ এন্ড লাভ সব কিছুকে পিছনে ফেলে বেহেস্ত তৈরী করতে পারে।———-। ভালোবাসার উপরে মানব জীবনে আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয়না।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক