সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবিদেরও শুদ্ধি দরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৩১:২২,অপরাহ্ন ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৬৭৬ বার পঠিত
মুনজের আহমদ চৌধুরী
শুধু সাংবাদিকতার নাম করে আমারই স্ব-পেশার কিছু অগ্রজ ঢাকা শহরে অনেক কিছুর মালিক হয়েছেন। তাদের এখন আর সাংবাদিকতার বেতনের টাকায় জীবন যাপন করতে হয় না। এরা প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তরের সুযোগে বন্দনার বাণী পাঠ করেন। সমস্ত লজ্জার মাথা খেয়ে নৈতিকতার মুখে ছাঁই দিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নির্লজ্জ দালালি করেন। দালালির আয়ে অর্জিত সুবিধার বলে সাংবাদিক রাজনীতিবিদের মতো আচরণ করেন। বুদ্ধিজীবী সুবিধা বাগাতে আচরণ করেন বুদ্ধি প্রতিবন্দির মতো। জনগণকে করেন বিভ্রান্ত।
সম্প্রতি বাংলাদেশে অবৈধভাবে পরিচালিত ক্যাসিনোয় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এসব ক্যাসিনোর জুয়ার টাকার ভাগ পাওয়া সাংবাদিকদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল ও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ঢাকার মধ্যমসারির সাংবাদিকেরা। আরসব পেশাজীবীদের মতো সাংবাদিকতা পেশার ক্ষমতাসীনরা সব সময়েই আকণ্ঠ অস্বচ্ছতায় নিমজ্জিত।
বহুদিন ধরেই আমাদের দেশের মূলধারার সাংবাদিকতা আবর্তিত হচ্ছে এক একটি হুজুগ বা ইস্যুকে ঘিরে। একই জিগিরে সুর তোলে সবাই। এখন যেমন হচ্ছে কথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে।
সুবিধার দাসত্বের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া কলমকে আর যাই হোক, সাংবাদিকতা বলে না। কথাটি যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য- বর্তমান সময়ে সব পেশাজীবীদের চিত্রই এক। আসলে সামাজিক অসুখগুলো ‘সুখ’ হয়ে ওঠা-ই ন্যায় ও সাম্যময় সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়।
সেই ওয়ান ইলেভেনে যারা সেনাশাসনের পক্ষ নিয়ে শেখ হাসিনার বিপক্ষে বা খালেদা জিয়ার পক্ষে লিখতেন তারাই আজ রীতিমত মুজিবকোট পরা বঙ্গবন্ধু প্রেমিক। কয়েক দিন আগেও এরা তারেক জিয়ার সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠতা, হাওয়া ভবনের আপ্যায়ন কেমন পেলেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করেছেন। নিয়েছেন নানা সুবিধা।
দেশের ৯৫ শতাংশ সাংবাদিক (বিশেষত মফস্বলের) এখনও মানবিক বেতন কাঠামোর ভেতরেই নেই। ঢাকার সিংহভাগ সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরেই অস্থিরতা প্রকট। তা সত্ত্বেও সাংবাদিকতা করে কিছু সংখ্যক মানুষ নিজে তো বটেই পাশাপাশি স্ত্রী, শ্বশুর ও স্বজনদের এখন এমপিও বানাচ্ছেন। দুঃখজনকভাবে সত্যিটা হলো এরকম সাংবাদিকের সংখ্যা অল্প হলেও প্রচলিত সাংবাদিকতার নাটাই তাদের হাতেই। বড় হাউস, প্রজেক্ট সব তাদের নিয়ন্ত্রণে।
ভাগ্যবান সে মানুষগুলো কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়েন, গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় একাধিক প্লট-বাড়ি। সন্তানরা পড়ে বিদেশ। অর্থের সব উৎস থেকে ভাগ পাওয়া এসব সম্পাদক-সাংবাদিকের স্ত্রী শপিং করতে যান সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে। আবার সেই সব সম্পাদকের হাউসের কর্মীদের বেতন আটকে থাকে মাসের পর মাস। মালিক বা নিজের পছন্দ না হওয়ায় হঠাৎ করে চাকরিচ্যুত করেও সাংবাদিকের বেতন আটকে রাখেন বহু বছরের বেতন। পাওনা বেতনের আশায় ঘুরতে থাকা হতভাগ্য সাংবাদিকের সন্তানের দুধ কিনতে না পারার বেদনা, মধ্য বয়সে পেশাবদলের গ্লানি আমাদের ক্ষমতাসীন শীর্ষ সাংবাদিকদের ছুঁতে পারে না। আগের এরশাদ, জিয়া বা খালেদা সরকারের সময়েও পারেনি।
সুবিধাবাদের গোলামী আর দাসত্বের দামে তারা অনেক কিছু পেয়েছেন। বেঁচে দিয়েছেন নৈতিকতা। জনবিরোধিদের কাছ থেকে সুবিধা আর বড় চাদা আর ভাগ নেওয়ার বড় অভিযোগটি বরাবরই ক্ষমতাসীন দল আর পুলিশের পর সাংবাদিকদের ওপর বর্তায়। অথচ নেতা পুলিশ আর সাংবাদিক; এই তিন পেশার মানুষই বিপদের দিনে সাধারণ মানুষের আস্থার নাম। তবুও এই তিন পেশার মানুষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশের সমাজব্যবস্থায় আস্থাহীনতা প্রবল। একজন রাজনীতিবিদের অসততা সমাজের যতটা ক্ষতি করে, বুদ্ধিজীবীদের নীতিহীনতা ক্ষতি করে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কতটুকু পেশাদার, কতটা বৃত্তির গন্ডি ছাপিয়ে পেশা হতে পেরেছে সেটি আজ বড় প্রশ্ন। প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকতা আজ কঠিন সময় পার করেছে। এর দায় শুধু সরকার বা মালিকপক্ষের নয়, এ দায় সাংবাদিকতার জৈষ্ঠ্যদেরও। আজকের বাংলাদেশে প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিকরা পেশায় টিকতে না পেরে পেশা বদল করছেন। পেশার দুরাবস্থা দেখে আস্থা হারাচ্ছেন মেধাবীরা। বাংলাদেশ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কেন, পুরো বিশ্বের সংবাদমাধ্যম এখন টাকাওয়ালা তথাকথিত একটি এলিট শ্রেণীর নিরাপদ ভৃত্যে পরিণত হয়েছে।
আজকের বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের যেসব শীর্ষব্যক্তিদের এ পেশার আলোর দিশারি হওয়ার কথা ছিল তারা কতটা দুর্বল মেরুদন্ডধারী ও সুবিধাকামী সেটা মানুষ জানে। তারা দোষারোপ করেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে, ক্ষমতাসীন সরকারকে। আমার প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে এর আগে কি কখনো সরকার ছিলো না? এরশাদ বা খালেদা জিয়ার সময়েও কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিলো? তখনও তো সংবাদ প্রকাশের কারণে সাংবাদিক-সম্পাদক গ্রেফতার, পত্রিকা বন্ধের হাজার হাজার নজির রয়েছে।
বাস্তবতা হলো গণমাধ্যম গণমানুষের রুপ হারিয়ে ক্রমশ কেবল প্রচারমাধ্যমের রুপ নিচ্ছে। জনগন এসব পড়ছে, দেখছে কিন্তু বিশ্বাস কি করছে? করলে আদৌ কতটুকু করছে? আজকের তরুণ প্রজন্মের কতজন সংবাদপত্র পড়েন? তাদের আগ্রহ বিকল্প গণমাধ্যমে, সামাজিক মিডিয়ায়।
আমাদের চলচ্চিত্র, উপন্যাস, কবিতার সিংহভাগ আটকে আছে শুধু সস্তা প্রেমের গল্পে। ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু বা জিয়া হত্যাকাণ্ড, জাসদের উত্থান, নব্বইয়ের গণ আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, প্রবাসী শ্রমিকের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত বা মোটাদাগে বাংলাদেশের মানুষের জীবন সংগ্রাম আমাদের সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে প্রবলভাবে অনুপস্থিত। সাংবাদিকতাতেও তাই।
মানুষ কি চাইছে তাও কি ঠিকঠাক উঠে আসছে গণমাধ্যমে? গৎ বাঁধা গল্পের বাইরে, কলমে-কলামে আবেগের আত্মাহুতি, লুটে পড়া দাসত্বের গন্ডি ছাপিয়ে সমাজের মুক্তির পথটি দেখানোর দায়িত্ব বুদ্ধিজীবী আর সাংবাদিকের। বাস্তবতার নিরিখে সময়ের সংকটগুলো অন্তঃদৃষ্টি নিয়ে ব্যবচ্ছেদ আর মুক্তির পথ দেখানোর দায়িত্বটাও তাদের। যে সমাজে সাংবাদিকরা নগ্নভাবে ক্ষমতা আর সরকারের জার্সি গায়ে দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব (!) পালনে নামেন সে সমাজ ততটাই সংকটেন নিকটবর্তী হয়। যেখানে সাংবাদিকদের পেশাদার সংগঠনের সদস্যপদ নিয়ে জালিয়াতি, ভোটে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে সেখানে সহসা পরিবর্তনের আশাবাদের যে আকাশ তা মেঘাচ্ছন্নই থেকে যায়।
সাংবাদিকতা, লেখালেখি আর কলমে-কণ্ঠে যারা পেশাটাকে ইবাদাতের মতো-প্রার্থনার মতো পালন করতে চায়-এই পেশাটা ক্রমশ তাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। আমাদের অগ্রজরা, দায়িত্বশীলরা সময়ের কাছে, আগামী এবং ইতিহাসের কাছে নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবেন না।
পচন আর পতনের দুর্গে একদিন উন্মোচনের জয়রথ দেখবো, সেই আশাটুকু হারাই না। আশাটুকু হারালে যে আর হারাবার কিছু থাকে না।
তবে এও সত্য বহুদিন বিরোধীদলবিহীন বাংলাদেশের মানুষের কথা ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও বলতে পারছেন সাংবাদিকেরাই। তাতে জনমানুষের প্রত্যাশাপূরণ হচ্ছে না সত্য। একদল স্পষ্টত সরকারের পক্ষে আর অপরপক্ষ বিশেষত যারা বিদেশে এসাইলাম সিকার তারা সরাসরি শুধু সরকারবিরোধী। এ দুয়ের বাইরে জনগণের পক্ষের যে সাংবাদিকতা সেখানে কেবলই শুণ্যতা।
সময়ের সাংবাদিকতায় শুদ্ধতা আসুক, গণমানুষের কণ্ঠ ধ্বনিত হোক গণমাধ্যমে। গণতন্ত্র কোথায় আগে আসবে-সমাজে না রাষ্ট্রে সেটা ঠিক করতে সাংবাদিক আর বুদ্ধিজীবীদেরই পথ দেখাতে হবে।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট