ফ্রান্সের মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশী অভিবাসীদের পদচারণা
প্রকাশিত হয়েছে : ২:২৭:১১,অপরাহ্ন ০৪ মার্চ ২০২০ | সংবাদটি ১১৫২ বার পঠিত
এ.এম. আজাদ
দেশের বাইরে বসবাসের জন্য ফ্রান্স কখনোই অভিবাসী বাংলাদেশীদের প্রথম পছন্দের দেশ ছিল না। প্রবীণদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত অভিবাসীদের একটা বৃহৎ অংশ ফ্রান্সকে বসবাস নয় বরং ব্রিটেন যাওয়ার জন্য একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করতেন।
ফ্রান্সে বসবাসের প্রতিকূলতা হিসেবে প্রধান কারণসমূহ হিসেবে যেগুলো চিহ্নিত করা হত তার মধ্যে অন্যতম, ফরাসী ভাষা আয়ত্তকরণ,চাকুরী প্রাপ্তি, আবাসন, বসবাসের বৈধতাপ্রাপ্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্রিটেনে আদমপাচার অভিযোগে ফরাসী -ব্রিটিশ যৌথ পুলিশ অভিযানে ১৯৯৮ সালে প্রায় ৮১ জন বাংলাদেশী গ্রেফতার ও অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশী অভিবাসীদের অবৈধ রাস্তায় যুক্তরাজ্যে গমনে কিছুটা স্থবিরতা ও যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন সেদেশে অবৈধ বসবাসকারী ফ্রান্স এ আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশিদের পুশব্যাক শুরু করলে বলতে গেলে অনেকটা বাধ্য হয়ে ফ্রান্সে ফেরত আসতে হয় এবং এ সংখ্যা বাড়তে থাকে।
সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ফ্রান্স বেশ ভাল অবস্থানে থাকার করণে ক্রমাগতভাবে আশ্রয় আবেদন মনজুর, যুক্তরাজ্যে TR4 কিংবা স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন কোর্স এ আসা ছাত্রছাত্রীদের আগমন, চাকুরী ডিক্লারেশন এর মাধ্যমে বৈধতার সুযোগ ,ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে স্বপরিবারে আসা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণরা বসবাসের বৈধতা পাওয়া এবং স্থিতিশীল অবস্থান নেয়ার কারণে অতি দ্রুত বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।
এখানে বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্ম,তরুণ ও ছাত্রছাত্রীদের ফরাসী ভাষা আয়ত্তকরণের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে নবীন-প্রবীণ প্রবাসীরা নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা কাঠিয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশী মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নিয়মিত পরিশ্রমী কর্মদক্ষতা অব্যাহত রাখার কারণে কর্মক্ষেত্রে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও বাংলাদেশী শ্রমিকদের যথেষ্ঠ সুনাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
সঠিক কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় বর্তমানে ফ্রান্সে বর্তমানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার বাংলাদেশী ও ফরাসী-বাংলাদেশিদের বসবাস। বাংলাদেশের বাহিরে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির পরই বোধহয় তালিকায় এখন ফ্রান্স।
পর্যটক আকর্ষণের শীর্ষে থাকা শিল্প ও সাহিত্যের নগরী হিসেবে বিসশ্বাসীর কাছে পরিচিত এই দেশটিতে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসকারী অভিবাসী হিসেবে আমরা নিজেদেরকে মূলধারার সাথে নিয়ে যেতে এ পর্যন্ত কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি বা করা উচিত তা নিয়ে আমার নিজের একান্ত উপলব্দিগুলো কমিউনিটিতে শেয়ার করলাম।
শুরুর দিকে আসা বাংলাদেশিরা যেখানে নিজেদের মৌলিক চাহিদা মেঠানোর জন্য রীতিমত হিমশিম খেয়ে আসছিলেন সেখানে ফরাসী মূলধারায় নিজেদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে চিন্তাই করা অবান্তর মনে করতেন। কিন্তু দিন বদলের পরিক্রমায় প্রায় অর্ধশত বছর পর হলেও কিশোর বয়সে আসা ছেলে মেয়ে ও এখানে বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের ফরাসী -বাংলাদেশীরা এখন মূলধারার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার যে প্রয়াস আমাদের সামনে তুলে ধরছেন তা থেকে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, আমাদের সহযোগিতা থাকলে এই প্রজন্মের উদ্যোমী, আত্মপ্রত্যয়ী ও যোগ্য সন্তানেরা অতি শিগ্রই ফ্রান্সে আমাদের অবস্থানকে সুদৃড় করতে সক্ষম হবে ইনশাল্লাহ।
আসন্ন মিউনিসিপাল নির্বাচনে প্যারিস ও তার পার্শবর্তী এলাকা থেকে প্রায় ৭-৮ জন বাংলাদেশী বংশদ্ভুত কাউন্সিলর পদে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। আশা করি উনারা নির্বাচিত হবেন এবং পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতায় অসংখ্য অগণিত আমাদের যোগ্য সন্তানেরা মেয়র, সংসদ সদস্য এমনকি মন্ত্রী- প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়লাভ করে একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেকে প্রমান করতে সক্ষম হবে।
আমাদের উচিত দেশীয় বস্তাপচা রাজনীতির চর্চা না করে, দীর্ঘদিন যে কাজগুলো নিজেরা করতে পারিনি আমাদের প্রজন্মের হাতে সেই দায়িত্ব অর্পনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়তা করা।
কমিউনিটিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদেরকে উৎসাহ প্রদান করা। “ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশীদের একটি সম্মানজনক অবস্থানের স্বপ্ন দেখি আমরা” এরখম স্লোগান নিয়ে কাজ করা।
আমাদের প্রচার মাধ্যমকে আরো গতিশীল করা উচিত যাতে করে সঠিক তথ্য উপাত্তগুলো সাধারণ অভিবাসীদের নিকট দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হয়। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশী কমিউনিটিতে হাতে গুনা দুই একজন পেশাজীবী সাংবাদিক ছাড়া বাকি সবাই সেলফিবাজ ভুয়া, প্রচার এর জন্য এদেরকে অনুসরণ না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া সম্ভব।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় জনপ্রতিনিধিরাই যেহেতু জনগণের জন্য প্রশাসনিক, সামাজিক নিরাপত্তা ও মৌলিক সমস্যা সমাধানের রূপরেখা প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন সেহেতু আমাদেরকে সেই সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি হয় ছাড়া অবস্থান সমুন্নত রাখা সম্ভব নয়।
আমাদের জানমালের নিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নয়নের রূপক হিসেবে আমাদের প্রজন্মকে নেতৃত্বশীল করে গড়ে তুলে ফরাসী মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার যেন হয় আমাদের আগামীর অঙ্গীকার।