বিখ্যাত বইয়ের দোকানে এক বিকেল
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৩২:১১,অপরাহ্ন ০৮ মে ২০১৯ | সংবাদটি ১০৫০ বার পঠিত
এনায়েত হোসেন সোহেল :
বাংলাদেশের অনেক শহরের পাশ দিয়ে কিংবা বুক চিরে বিভিন্ন নদী কালের সাক্ষী হয়ে যুগ যুগ ধরে আপন আলোয় প্রবাহিত। তেমনি প্যারিস শহরের বুক চিরে প্রবাহিত স্যান নদী। এই নদীর দু-প্রান্ত শৈল্পিক সৌন্দর্য আর প্রকৌশলীদের উন্নত কারিগরি মারপ্যাঁচে আটকানো। আর আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর দু-প্রান্ত হিজিবিজি আর নোংরা ভাবে সাজানো। পার্থক্যের নিখুঁত বিচারে বলা যায় শিল্প সাহিত্য আর সংস্কৃতির লীলাভূমি এই প্যারিসে স্যান নদী যেন এক ব্যতিক্রম উপমা। নদীর দু প্রান্ত এমন ভাবে সাজানো গোছানো যে, এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নদীর দু-প্রান্তে গভীর রাত পর্যন্ত প্রাণ খুলে আড্ডা দেন।
প্যারিসের ওপর দিয়ে যত দূর পর্যন্ত স্যান নদী বয়ে চলেছে তত দূর পর্যন্ত কিছু দূর দূর নদীর পাড়ে রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের দোকান শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি অন্যতম। শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানিকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের দোকান। এই দোকানটি হলো প্যারিসের নোতরদাম গির্জা থেকে এক মিনিটের হাঁটা দূরত্বে স্যান নদীর তীরে। ফরাসি দেশে ইংরেজি ও আন্তর্জাতিকতার ঝান্ডা উড়ানো এই এক পৌরে দোকানটিকে ধরা হয় মহানগরী প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দু। এই অবস্থানকে বলে কিলোমিটার জিরো। যেদিন থেকেই জেনেছি এই অসাধারণ ঐতিহাসিক স্থানটির কথা, মনের গহিনে তীব্র ইচ্ছা জেগেছে মাদার অব রিটারেচার বা সাহিত্য জননী খ্যাত সিলভিয়া বিচ হুইটম্যানের প্রতিষ্ঠিত এই সাহিত্য তীর্থ পরিদর্শনের।
১৯১৯ সালে যাত্রা শুরুর পর এই দোকানকে কেন্দ্র করে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তির। খুব দ্রুত বইয়ের দোকান থেকে বিনা পয়সায় বই ধার দেবার ও কফি পানের জনপ্রিয় আসরে পরিণত হয়। আসরে আসতে থাকেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ লেখকেরা। যাদের মনে সোনালি স্বপ্ন লেখক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। দিবারাত্রি লিখে যান নতুন ধরনের সাহিত্য। কিন্তু প্রকাশকদের কাছে হলে পানি পান না একেবারেই নবিশ বলে। তবুও তাদের দল ভারী হতে থাকে দিনে দিনে।
এই বইয়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে আর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে অনেকেই খ্যাতি পেয়েছেন বিশ্ব জুড়ে। এর মধ্যে অ্যাজরা পাউন্ড, গ্যারট্রুড স্টেইন, হেনরি মিলার, জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিনক্লেয়ার লুইস, স্কট ফিটজেরাল্ড, স্যামুয়েল বেকেট, পল ভ্যালরি ছিলেন অন্যতম। এই শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির সাহচর্যে থেকে অনেকের একের পর এক ছড়িয়েছে যশ, খ্যাতি ও সম্মান। ছিন্ন ঝুলি ভরে উঠতে থাকে পুরস্কারের পর পুরস্কারে। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হন বেশ কয়েকজন। কিন্তু সবাই পান তার চেয়েও বড় পুরস্কার। অর্থাৎ পাঠকের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর লেখনীর অমরত্ব। তাদের আড্ডার স্থান ছিল শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। এক জীর্ণ পুরোনো বইয়ের দোকান। কিলোমিটার জিরো, প্যারিস।
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের দোকান শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির ওয়েব সাইট ঘেঁটে জানা যায়, সাহিত্যচর্চার বাসনা নিয়ে ইতালি যাচ্ছিলেন সাবেক আমেরিকান সেনা আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। পথে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে প্যারিসে এসে আস্তানা গাড়েন। ক্লায়ক্লেশে কেরানিগিরি করে জীবন চালাচ্ছিলেন জেমস জয়েস। বিশাল বই ইউলিসিস লেখা প্রায় শেষ। কিন্তু ছাপতে রাজি হচ্ছেন না কেউ। এগিয়ে এলেন সিলভিয়া বিচ হুইটম্যান। এগিয়ে এল শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। আর এখন সবারই জানা গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হওয়ার অতি দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছে ইউলিসিস।
নতুন নতুন লেখকদের আড্ডা তখন জমত শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানিতে সমানে। তাদের বাউন্ডুলেপনা দেখে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সেরা লেখিকা গ্যারট্রুড স্টেইন হেমিংওয়ে ও তার বন্ধুদের উদ্দেশে বলেছিলেন, You are Lost Generation. সোজা বাংলায় গোল্লায় যাওয়া প্রজন্ম। অথচ তারাই পরবর্তীতে আবির্ভূত হলেন একেকজন বিশ্বসাহিত্যের দিকপাল হিসেবে। মূল কারণ শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির আড্ডা, সাহচর্য ও সাহায্য।
স্বপ্ন পূরণের দিন বিকেলে বাংলাদেশের পুথিশিল্পী কাব্য কামরুন, সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেন, প্যারিসের তরুণ ব্যবসায়ী ফয়জুর রহমান ও আমি স্যান নদীর লাভ লক ব্রিজের কাছে দেশি বিদেশি মনখোলা প্রাণচাঞ্চল্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এক সময় নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এসে থমকে দাঁড়ালাম শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির বিশ্বখ্যাত বইয়ের দোকানের সামনে। দোকানটিতে প্রবেশের আগে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সাইনবোর্ডের দিকে চেয়ে। সেখানে শেকস্পিয়ারের অঙ্কিত মুখ আর নাম লেখা।
দোকানের নামের শেষে লেখা বিশ্বের সমস্ত বইপ্রেমী এর অংশীদার। এমনটাই স্বপ্ন দেখতেন সিলভিয়া। পরে দোকানের দায়িত্ব নেন জর্জ হুইটম্যান। যিনি নিজেকে আমেরিকান মহাকবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের জারজ প্রপৌত্র বলেই পরিচয় দেন দুষ্টমিভরা হাসি দিয়ে।
সামনের কাঠের বাক্সে কিছু বই আর দরজার পাল্লা ঠেলে ভেতরে পা দেওয়া মাত্রই বইয়ের সাম্রাজ্যে পদার্পণ। সব বিষয়ের বই সামর্থ্য মতো বিষয় মতো সাজানো আছে। এক জায়গায় লেখা পোয়েটস কর্নার। পেছনে রাজ্যের যত কবিতার বই। সিঁড়িতে লেখা মনুষ্যত্বের জন্য বাঁচো।
নতুন ও প্রথা বিরোধী সাহিত্যিকদের পাশে বরাবরই দাঁড়িয়েছে শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। দেখলাম বিট জেনারেশনের সকল বই কয়েক তাক জুড়ে থরে থরে সাজানো। তাতে জ্যাক কেরুয়াক, আল্যান পিন্সবার্গ, গ্রেগরি করসোর ভিড়। দোকানের আরেক অংশে উচ্ছনে যাওয়া প্রজন্ম অর্থাৎ হেমিংওয়ে ও তার সমসাময়িক আড্ডার লেখকদের সাহিত্যকর্মের সম্ভার।
ভেতরে গিয়ে দেখলাম অনেক ভিড় সেখানে। কিন্তু সবাইকে ক্রেতা ভাবলে ভুল হবে। অনেকেই এক কোণে বসে পছন্দের বইটি টেনে নিয়ে পড়ে যাচ্ছেন নিবিষ্ট মনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দোকান যতক্ষণ খোলা আছে ততক্ষণ। এভাবে বই পড়ার অধিকার আছে সকল পাঠকের। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৯৫ বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনো।
- আগে দোকানে বড় করে লেখা থাকত TAKE WHAT YOU NEED, GIVE WHAT YOU CAN মানে দোকানে বইয়ের নির্দিষ্ট কোনো মূল্য ছিল না। এর দাম নির্ভর করত পাঠকের ওপরেই। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অনেক ভিন্ন। প্রতিটি বইয়ের সঙ্গেই নির্দিষ্ট মূল্যের ট্যাগ। দাম বেশ চড়া। নিশ্চয়ই এই অসাধারণ জায়গাটির ইতিহাসের কারণেই।
যেখানেই বিন্দু পরিমান জায়গা ফাঁকা পাওয়া গেছে সেখানেই বইয়ের স্তূপ। সেই সঙ্গে দুর্লভ সব আলোকচিত্র ঝুলছে দেয়ালে আর কিছু পোস্টার। একেবারে পেছনে গেলে পাওয়া যাবে দোতলায় যাওয়ার কাঠের সিঁড়ি। ওপরে জর্জ হুইটম্যানের আস্তানা এবং সেই সাথে পৃথিবীর একমাত্র লেখকদের হোটেল অর্থাৎ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের লেখক এখানে এসে বিনা মূল্যে রাত্রি যাপন করতে পারবেন। আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরাও এক রাত থাকব। কিন্তু স্থায়ীভাবে প্যারিসে বসবাস করায় এই নিয়মে পড়লাম না। জানা গেল, কয়েক হাজার লেখক থেকে গেছেন এখানে। দোতলায় রয়েছে গ্রন্থাগার আর সাহিত্যবিষয়ক নানা রকমের ওয়ার্কশপ চালানোর স্থান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী প্যারিস দখল করে। তখন দোকানে রাতে আলো জ্বালিয়ে রাখত শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। পরে এক জার্মান ক্যাপ্টেনের হুমকির মুখে আত্মগোপন করেন সিলভিয়া হুইটম্যান। বছর চারেক পর মিত্রবাহিনীর প্যারিস জয় করে। মজার ব্যাপার হলো মিত্রবাহিনী যখন দোকানে আসে তখন অগ্রভাগে ছিলেন পুরোদস্তুর সৈনিকের ইউনিফর্ম গায়ে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তার বিখ্যাত স্মৃতিকথা A Movable Feast-এ সেই পুরোনো দিনগুলোর কথা অমর হয়ে আছে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পর আগের সেই জায়গায় দোকান আর চালু হয়নি। তা নিয়ে আসা হয় স্যান নদীর তীরে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো গোটা দোকান ঘুরে আমরা কিছু বই কিনলাম। সবার আগে ওয়াল্ট হুইটম্যানের লিভস অব গ্রাস। এ বার দাম চুকানোর পালা। পুথিশিল্পী কাব্য কামরুল এগিয়ে গেলেন। এ ব্যাপারে তিনি পারদর্শী। বইয়ে রয়েছে শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির বিশেষ সিল। যেকোনো বইপ্রেমীর কাছেই এই সিলের মূল্য অপরিসীম। প্রমাণ হয় বইখানা এসেছে মহাগ্রন্থ তীর্থ থেকে। ক্রেতাদের জন্য এটা বিরাট এক আকর্ষণ। সিলের মাঝখানে উইলিয়াম শেকস্পিয়ারের ছাপচিত্র, তার চারপাশে দোকানের নামসহ লেখা কিলোমিটার জিরো, প্যারিস।জর্জ হুইটম্যান এখন আর ইহজগতে নেই। থাকলে হয়তো তার নিজ মুখে জানা যেত অনেক কিছু। তার বংশধরেরা পরিচালনা করে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিদিন পৃথিবীর হাজার হাজার বইপ্রেমী ভিড় জমান এই ঐতিহাসিক বইয়ের দোকানে। এ ধারা হয়তো থাকবে বহমান। অদূর ভবিষ্যতে নিজের কোনো বই প্রকাশিত হলে অন্তত একবার থাকার অনুমতি চাইব, এই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বিদায় নিলাম এই যাত্রায়।