বাবা, বাবার বাবা সবার পেশাই পকেট কাটা
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৫৫:২৭,অপরাহ্ন ২২ জানুয়ারি ২০২০ | সংবাদটি ৩৯৬ বার পঠিত
তৃতীয় বাঙলা ডেস্কঃ
সুমনের (আসল নাম নয়, শিশু হওয়ায় নাম প্রকাশ করা হলো না) বয়স ১৩ বছর। বাবা, বাবার বাবা—সবার পেশাই মানুষের পকেট কাটা। সুমন জানাল, তাদের বাড়ি বগুড়া শহরের চেলোপাড়া সান্দারপট্টিতে। পড়াশোনা করেনি। পারিবারিক পরিমণ্ডল, আবহ তাকে এই পেশায় নিয়ে এসেছে। এখন সে পাঁচজনের একটি দল চালায়। সবাই কমবেশি তারই বয়সী।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এখন বগুড়া শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৩০০ পকেটমার। পকেটমারের তালিকায় যেমন আছে সুমনের মতো কিশোর, তেমনি আছে নারী সদস্যসহ মাঝবয়সী পুরুষরাও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের ফতেহ আলী বাজার, গালাপট্টি, নিউ মার্কেট, সাতমাথা, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন বিপণিকেন্দ্র টার্গেট করে এরা মানুষের সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়। এরা মিশে থাকে মানুষের মধ্যে। এরা ফাঁদে ফেলে বিশেষ করে বগুড়ায় কাজে আসা বা বেড়াতে আসা লোকজনকে। সুযোগ পেলে এদের কেউ কেউ ছিনতাই করতেও পিছপা হয় না।
নারী পকেটমাররা টার্গেট করে পুরুষের পকেট, নারীদের ভ্যানিটি ব্যাগ। চার-পাঁচজনের দল নিজেদের মধ্যে ভিড় তৈরি করে কেনাকাটা করতে আসা নারীদের ব্যস্ত রাখে। এরপর কৌশলে ব্যাগের চেইন খুলে বা কেটে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা, মুঠোফোন ও মূল্যবান গয়না।
দিন শেষে পকেটমারের হাতিয়ে নেওয়া এসব মুঠোফোন ও মূল্যবান জিনিসপত্র বিকিকিনির জন্য সান্দারপট্টি এলাকার কয়েকটি স্থানে বসছে গোপন বাজার। সেখানে চলছে কেনাবেচা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও থানা-ফাঁড়ি পুলিশ বিষয়টি জানার পরও নিচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। এ কারণে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে এদের দৌরাত্ম্য।
বগুড়া সদর থানার একটি সূত্র জানায়, পকেটমারের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারানো মানুষের বেশির ভাগই থানায় অভিযোগ করে না। তার পরও প্রতিদিন লিখিত-মৌখিক মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫টি অভিযোগ আসে। এর মধ্যে সৌভাগ্যবান দু-একজন হয়তো প্রতিকার পায়। তবে এ ক্ষেত্রে লাগবে প্রভাবশালীদের সুপারিশ।
বগুড়া সদর ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর আবুল কালাম আজাদ বলেন, পকেটমার সারা শহরে ছড়িয়ে আছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোও একটা সমস্যা। কারণ প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। দেখা যায় ধরে আনলে উল্টো সামলানো দায় হয়ে পড়ে। তিনি স্বীকার করেন, এরাই রাত নামলে নেমে পড়ে শহরের রাস্তাঘাটে। এদের অনেকেই দিনে পকেটমার, রাতে হয়ে ওঠে ভয়ংকর ছিনতাইকারী। এরা অস্ত্রও ব্যবহার করে থাকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনের পকেটমার আর রাতের ছিনতাইকারীদের সঙ্গে থানা-ফাঁড়ির পুলিশের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং এলাকার প্রভাবশালীদের রয়েছে অন্য রকম সখ্য। পকেট কেটে, নারীর ব্যাগ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা-পয়সা ও মুঠোফোন, মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রির অর্থের ভাগ যাচ্ছে পুলিশ ও নেতাদের পকেটে। এ কারণে পুলিশ অ্যাকশন চালায় না। অভিযোগ করে কোনো কাজ হবে না জেনে ভুক্তভোগীরাও সর্বস্ব হারানোর পর পুলিশকে জানাতে চায় না।
পকেট কাটতে গিয়ে অথবা ছিনতাই করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে দু-একজন জনতার হাতে ধরা পড়লেও পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে বেরিয়ে আসে দ্রুতই। থানায় সোপর্দ করার পর পকেটমারকে ছাড়িয়ে নিতে পুলিশের কাছে তদবির করেন অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রভাবশালীরা। টাকা-পয়সার বিনিময়ে তাদের থানা থেকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে একাধিক। মাঝে মাঝে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হলেও জামিনযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের পাঠানো হয় জেলহাজতে। দু-এক দিনের মাথায় জামিনে বেরিয়ে গিয়ে আবারও পুরনো সেই কাজে জড়িয়ে পড়ে তারা।
শহরের ব্যবসায়ী, এলাকাবাসী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের পকেটমারের বেশির ভাগই চেলোপাড়া-সান্দারপট্টি এলাকার। এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি। সান্দারপট্টির পকেটমার পল্লীটিও তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। এমন উদাহরণও আছে, পুলিশের কাছ থেকে তাঁর কাছে অনুরোধ পৌঁছানোর পর এক ঘণ্টার মধ্যে খোয়া যাওয়া মালপত্র ফেরত পাওয়ার।
স্থানীয়রা জানায়, পকেটমার পল্লীর বেশির ভাগ পকেটমারই মাদকসেবী। হেরোইন, ইয়াবাসহ নানা নেশায় আসক্ত তারা। সেখানে ১২ বছরের শিশু থেকে ৬০ বছর বয়সী পকেটমারও রয়েছে। সান্দারপট্টি ছাড়াও শহরের নামাজগড়, সেউজগাড়ি, সূত্রাপুর এলাকায়ও রয়েছে বেশ কিছু পকেটমার।
এদের বিচরণ সবচেয়ে বেশি শহরের ফতেহ আলী বাজার, নিউ মার্কেট, গালাপট্টি, চাদনীবাজার, কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, সাতমাথা, সপ্তপদী মার্কেট, রেলস্টেশন এলাকা। হালিম (আসল নাম প্রকাশ করা হলো না) নামের একজন পকেটমার বলে, কার পকেটে টাকা আছে সেটা তারা লোকজনকে দেখলেই আঁচ করতে পারে। এরপর টার্গেট করে তাঁর পিছু নেয়। একজনে সম্ভব না হলে কয়েকজন মিলে একটা পকেট কাটে। সে ক্ষেত্রে নিজেরাই ভিড় তৈরি করে। কোনো কোনো সময় টার্গেট করা ব্যক্তিকে নানা কৌশলে ধরাশায়ী করে সর্বস্ব লুটে নেয় তারা। পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়লে জনতার হাত থেকে উদ্ধারের জন্য আশপাশে থাকা অন্য পকেটমাররা নানা ফন্দির আশ্রয় নেয়। কখনো নিজেরাও দু-চার ঘা লাগিয়ে পুলিশে দেওয়ার কথা বলে ধরা পড়া পকেটমারকে কবজায় নেয়। এরপর কৌশলে পালাতে সহায়তা করে।
পকেট কেটে হাতিয়ে নেওয়া মুঠোফোন, মূল্যবান জিনিসপত্র কিংবা রাতে ছিনতাই করা মালপত্র কেনাবেচার জন্য সন্ধ্যার পর শহরে বাজার বসে। সান্দারপট্টি ছাড়াও শহরের ফতেহ আলী বাজারের রেলগেট এবং স্টেশনের সামনে হাড্ডিপট্টি এলাকায় রয়েছে এসব চোরাই পণ্য কেনার কয়েকটি দোকান।
দিনের বেলা পকেট কেটে পাওয়া দামি মুঠোফোনের বেশির ভাগ বিক্রি করা হয় হাড্ডিপট্টি আরিফ হোটেল এলাকায় আব্দুল মোমেন নামে একজনের কাছে। পকেটমারদের কাছ থেকে এসব পণ্য কম দামে কেনার জন্য তিনি সব সময় প্রস্তুত থাকেন। তাঁর নিয়োগ করা চার-পাঁচজন যুবকও রয়েছে সেখানে। তবে আব্দুল মোমেন বলেন, তিনি অবৈধ কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন।
পকেটমারদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়ি, নারুলী পুলিশ ফাঁড়ি এবং সদর থানার কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
বগুড়া সদর ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর আবুল কালাম আজাদ বলেন, পকেটমাররা শহরে পকেট মারলেও তারা যেখানে বসবাস করে সেটা নারুলী পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায়। তবে তিনি পুলিশের পক্ষ থেকে মাসোয়ারা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে নারুলী ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর জামিরুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুদিন আগেও কয়েকজন পকেটমারকে ধরে হাজতে পাঠিয়েছি। পকেটমারের উৎপাতের কারণে আমাদেরও অন্য কাজে বিঘ্ন ঘটছে।’ পুলিশের সঙ্গে সখ্যের বিষয়টি ঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন।
সৌজন্য – কালের কণ্ঠ