জটিল রোগ লিভার সিরোসিস
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৫৭:২৩,অপরাহ্ন ৩১ মে ২০১৯ | সংবাদটি ৫২৭ বার পঠিত
তৃতীয় বাঙলা ডেস্কঃ
খুব জটিল একটি রোগের নাম ‘লিভার সিরোসিস’, যাতে লিভার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়। তবে শুরুতে শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন-আল-মাহতাব (স্বপ্নীল) .
লিভার সিরোসিস লিভার বা যকৃতের ক্রনিক রোগ, যাতে লিভারের সাধারণ আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে, তবে তা কিন্তু এক দিনে হয় না। মারাত্মক পর্যায়ের সিরোসিসে যকৃতের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাই এই রোগকে অবহেলা না করে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।
লক্ষণ
লিভার সিরোসিস আক্রান্ত রোগী অনেক বছর পর্যন্ত কোনো রকম লক্ষণ বা উপসর্গ ছাড়াই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। প্রাথমিকভাবে কম্পেনসেটেড সিরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে। অর্থাৎ লিভারে ব্যাপক ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সিরোসিসের তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এর পরও কিছু সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে। যেমন :
❏ অবসাদ বা শারীরিক দুর্বলতা, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া
❏ দাঁতের মাড়ি বা নাক থেকে রক্ত পড়া
❏ ক্ষুধামান্দ্য
❏ বমি বমি ভাব
❏ ওজন কমে যাওয়া
❏ চামড়া বা ত্বক এবং চোখের হলুদ ভাব (জন্ডিস)
❏ পেটের ডানপাশে ব্যথা
❏ জ্বর জ্বর ভাব
❏ ঘন ঘন পেট খারাপ হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আবার অ্যাডভান্সড সিরোসিসের চিত্রটি অন্য রকম হয়। এ সময় যা হতে পারে তা হলো :
❏ পায়ে-পেটে পানি আসা
❏ মারাত্মক জন্ডিস এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
❏ কথাবার্তার মধ্যে এলোমেলো ভাব দেখা দেওয়া
❏ কারো কারো ক্ষেত্রে খাদ্যনালির শিরা-উপশিরা থেকে রক্তপাত হয়ে রক্তবমি হওয়া ও পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া
❏ ফুসফুসে পানি আসা
❏ কিডনি ফেইলিওর
❏ শরীরের যেকোনো জায়গা থেকে আনকন্ট্রোলড ব্লিডিং দেখা দিতে পারে। এসব হচ্ছে সিরোসিসের শেষ স্তর। লিভারে দেখা দিতে পারে ক্যান্সারও।
কারণ
বিভিন্ন দেশে লিভার সিরোসিসের কারণগুলোও ভিন্ন। ইউরোপ ও আমেরিকায় সিরোসিসের প্রধান কারণ অ্যালকোহল আর হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজার রোগীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, এ দেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের আক্রমণ। দেশে প্রায় দুই কোটি লোক হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’ কিংবা ফ্যাটি লিভারের মতো লিভারের নানা রোগে আক্রান্ত। পাশাপাশি হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’র মতো অ্যাকিউট হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর প্রকোপও অনেক বেশি।
দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজারের মতো লোক লিভারের রোগে মৃত্যুবরণ করে।
সিরোসিসের কারণ হিসেবে হেপাটাইটিসের ঠিক পরেই রয়েছে ফ্যাটি লিভার বা লিভারে চর্বি জমা। ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া (রক্তে চর্বি বেশি থাকা), ওবেসিটি (মেদ-ভুঁড়ি), উচ্চ রক্তচাপ আর হাইপোথাইরয়েডিজম ইত্যাদিও কারণ। পাশ্চাত্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়। এ দেশেও ফ্যাটি লিভারজনিত লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের রোগী পাওয়া যাচ্ছে বেশি। এ ছাড়া কিছু জন্মগত অসুখের কারণেও এই সমস্যা হয়ে থাকে। যেমন : উইলসন ডিজিজ, হেমোক্রোমেটাসিস ইত্যাদি।
চিকিৎসা
লিভার সিরোসিসের আধুনিকতম চিকিৎসা এখন এ দেশেই সম্ভব। দেশেই তৈরি হচ্ছে বেশির ভাগ ওষুধ। এ দেশে এখনো লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ব্যবস্থা চালু হয়নি। প্রতিবেশী দু-একটি দেশে এ সুযোগ থাকলেও তা খুবই ব্যয়বহুল; ফলে এ দেশের বেশির ভাগ রোগীর সাধ্যের অতীত।
লিভার সিরোসিসে শেষ কথা বলে কিছু নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে সিরোসিসের রোগীকে শনাক্ত করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। কারো লিভার সিরোসিস একবার হয়ে গেলে চিকিৎসা দিলেও তার শরীর পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। সুতরাং সিরোসিসের কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা করা উচিত। আর্লি সিরোসিসে তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না বলে রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের সচেতনতা এ ক্ষেত্রে খুব জরুরি।
প্রতিরোধে করণীয়
প্রতিরোধই পারে লিভার সিরোসিস রোগে মৃত্যুর হার কমাতে। লিভার সিরোসিস প্রতিরোধে কিছু করণীয় হলো—
❏ অতিরিক্ত অ্যালকোহল বর্জন করুন।
❏ রক্ত দেওয়া বা নেওয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন। এসব ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা দিন।
❏ কম তেলযুক্ত খাবার খান। তেলে ভাজা গুরুপাক বা মসলাদার খাবার, জাংক ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
❏ দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় বেশি করে রাখুন শাকসবজি ও ফলমূল।
❏ ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহারের আগে সতর্ক হোন।
❏ প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।
❏ নিরাপদ যৌনসম্পর্ক বজায় রাখুন।
❏ হেপাটাইটিস ‘বি’র প্রতিষেধক নিন। পাশাপাশি দূষিত কোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে অপারেশন করা, দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালন প্রতিরোধ করুন। সেলুনে সেভ করাসহ যেকোনো কাটাকাটি বা সেলাইয়ের সময় এই বিষয়গুলো মাথায় রাখুন।
❏ কেউ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত কি না জানতে স্ক্রিনিং করুন। ‘বি’ বা ‘সি’তে আক্রান্ত হলে নিয়মিত স্ক্রিনিং করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন; কেননা লিভার সিরোসিস প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে তা অনেক ক্ষেত্রে নিরাময় করা সম্ভব।
❏ শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমান।
❏ ফ্যাটি লিভারের নিয়মিত চিকিৎসা নিন।