ভুল করে নটর ডেম চার্চে
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:২২:২৫,অপরাহ্ন ২৭ এপ্রিল ২০১৯ | সংবাদটি ৮৭৯ বার পঠিত
পারমিতা হিম প্রথম যেদিন প্যারিস শহরে ঢুকি, আমাদের গাড়ির আলজেরিয়ান ড্রাইভার তার দুর্বোধ্য ইংরেজিতে একটা জায়গার তাৎপর্য বোঝানোর চেষ্টা করছিল। আমি তার ভাষার কিছুই বুঝিনি। এটুকু শুধু বুঝেছি, আমরা তখন যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি সেই রাস্তার মোড় খুব বিখ্যাত জায়গা। আমি গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম একটা চার্চ আর তার বিশাল লম্বা চূড়া। ভাবলাম, কাজ শেষে যখন ফ্রি হবো তখন এই মোড়টা ঘুরে যাব।
দিন চলে গেল। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা। প্রতিদিন তিনটা প্রোগ্রাম। সন্ধ্যায় হোটেলে ঢুকে ডিনার করে পরদিনের প্রস্তুতি। এভাবেই নরমেন্ডি, তুল্জ শহরেও ঘুরে আসা। প্যারিসের কর্মহীন প্রথম দিন নাটাই ছাড়া ঘুড়ির মতো ঘোরাঘুরির প্রস্তুতি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সেই মোড়ে। মোড়ের সেই গির্জার সামনে দেখি অনেক লোক, আমারই মতো ট্যুরিস্ট। গির্জার ভেতরে ঢুকে থ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর সব ফ্রেসকো! পিলারে খোদাই করা কী নিখুঁত সব কারুকাজ! দেয়ালে খোদাই করা একেকটা চিত্রকর্ম দেখব, নাকি সেখানকার মূর্তিগুলো! আমি একটা চেয়ারে চুপ করে বসে পাগলের মতো চারপাশ দেখলাম। এমন সময় এক প্রবীণ লোক আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন।
আমাকে দেখে থমকে গেলেন।
বললেন, প্যারিসে ফার্স্ট টাইম?
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ।
বললেন, ইন্ডিয়া থেকে এসেছ?
আমি বললাম, না; বাংলাদেশ থেকে। আপনি কি বাংলাদেশ চেনেন?
উনি হেসে বললেন, হ্যাঁ, চিনি। গার্দু নর্দে অনেক বাংলাদেশি থাকে।
ওই জায়গাটা কেমন নোংরা হবে নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষ্যিত জ্যাকসন হাইটসের মতো; ভাবতেই লজ্জা পেয়ে গেলাম।
আমার লজ্জা ভেঙে লোকটা বললেন, তুমি কি এখানে একটা ছবি তুলতে চাও? আমাকে তোমার মোবাইল দাও, তুলে দিচ্ছি।
পুরো ফ্রান্স ঘুরেই এমন দেখছি। লোকজন ভীষণ আন্তরিক। আমি শুনেছিলাম, ফরাসিরা খুব অহঙ্কারী জাতি। বেশ ভাব নেয়। এখানে এসে দেখি ঘটনা উল্টো। আমি লোকটাকে আমার মোবাইল ফোন দিলাম। তিনি আমার একটা ছবি তুলে দিলেন। তারপর কোথায় চলে গেলেন!
আমি আবার ঘুরতে শুরু করলাম গির্জার ভেতরে। কোথাও ক্রুশবিদ্ধ যিশু, কোথাও মমতাময়ী মেরি, কোথাও আবার দানবের টুঁটি চেপে ধরা সিংহ। পুরোটা ঘুরতে ঘুরতে প্রার্থনার সময় হয়ে গেল। গির্জার ঘণ্টা ঢং ঢং করে বাজছে। নীরব গির্জার মধ্যে যারা প্রার্থনায় যোগ দিতে আসছে তারা সামনের সারির চেয়ারে বসে গেল। একেবারে সামনে বিশাল কয়েকটা মোমবাতি জ্বেলে পাদ্রি প্রস্তুত বাইবেল হাতে। পাদ্রিকে দেখে আমি চমকে গেলাম। এ তো সেই প্রবীণ লোক! এখন পাদ্রির পোশাক পরা। একজন পাদ্রিকে দিয়ে ছবি তোলালাম আমি! ভেবে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে আমি চলে গেলাম পেছনে।
হঠাৎ কানের মধ্যে মোচড় দিয়ে বিষণ্ণ গম্ভীর সুর বাজতে শুরু করল সবখানে। কান থেকে সুরটা আলতো করে নামতে নামতে ঢুকে গেল বুকের মাঝখানে। আমার চোখ বেয়ে তখন টপটপ করে পানি পড়ছে। প্রতি সন্ধ্যা কি এমনই বিষণ্ণ সব শহরে?
আমাদের ছোটবেলার সন্ধ্যা এমনই। মা পূজার শাড়ি পরে আসনের সামনে বসত। আমরা তার পেছনে। নানা রকম প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতাম আমরা। আমি হারমোনিয়াম বাজাতাম, বোনেরা খঞ্জনি। আমি যেন প্রাচীন যুগে চলে গেলাম। আমার মনে হলো, লাখ লাখ বছর ধরে আমি এই প্রার্থনার মধ্যেই ছিলাম। মাঝে যৌবনকালের ঘনঘটায় নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেলেছিলাম! আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করল। আমার জীবনে এই সন্ধ্যাগুলো আর নেই। প্রার্থনার মোমবাতি কোনো ঘরে জ্বলে ঠিকই, আমি সেখানে যাই না আর। একটা অদ্ভুত বিমানে চড়ে হাজার হাজার মাইল পেছনে আমাদের সন্ধ্যাগুলো ফেলে এক অজানা দেশে চলে আসছি যেন। সেখানে আর ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
আমি দৌড়ে চলে এলাম প্রার্থনার মাঝখান থেকেই। রাস্তা পার হয়ে দেখি এ চত্বরের নাম জ্য পল স্যঁত্র- সিমোন দ্য বোভোয়া চত্বর। গুগল আমাকে বলল, আমার সামনের এই রেস্তোরাঁতেই বিকেলবেলা কফি খেত সিমোন দ্য বোভোয়া-স্যঁত্র, পাবলো পিকাসো আসতেন তার বান্ধবীকে নিয়ে। এখানে বসে বসে লিখতেন হেমিংওয়ে!
হোটেলে ফিরে ছবিগুলো পোস্ট দিতে গিয়ে দেখি জায়গার নাম দেখাচ্ছে নটর ডেম চার্চ। এটাই তাহলে সেই আটশ’ বছরের পুরনো বিখ্যাত স্থাপত্য! নিজেকে বাহবা দিলাম। আবার কানেও ধরলাম, আর কোনোদিন সন্ধ্যাবেলা চার্চে যাব না, কাঁদব না মিছামিছি! ঈধহঃড় ফর ঋড়ৎুধ ইউটিউবে লিখে আপনিও শুনে দেখেন, কষ্ট লাগে কি-না!
পরদিন আমার ল্যুভর ভ্রমণ। ওরে বাবা, ল্যুভরের ভেতরে ঢুকবো কী! প্রাসাদের বাইরে দেখতে দেখতেই দেখা শেষ হয় না! ল্যুভর বন্ধ হয়ে গেলে সেইন নদীর পাড়ে এসে দেখি নদীতে ট্যুরিস্ট নিয়ে নৌকা চলে। এক বিশাল নৌকায় উঠে বসলাম আমি। নদীর দু’পাড়ে মিউজিয়াম, চার্চ, প্রাসাদ আর প্রাসাদ। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি! হঠাৎ দুই মাথা উঁচু এক বিশাল স্থাপত্য চোখে পড়ল। ছবি তুলে রাখলাম। অত দূর থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ওটা একটা বিশাল দালান হবে! আর দালানের ওপরে যে জাঁকজমক কারুকাজ, সেটা দূর থেকেও চোখ এড়ায় না।
রিভারক্রুজ শেষ। হোটেলে ফিরতে হবে। দলের সাথীরা কেউ আমাকে সকাল থেকে দেখেনি। জানে না আমি কোথায়। কিন্তু তখন মাত্র ৭টা বাজে। নদীর পাড়ে রিকশাওয়ালারা ডাকাডাকি করছিল। আমি ভাবলাম, ধীরে ধীরেই যাই। প্যারিসের রিকশাও চড়ি! মোটা মতো এক মেয়ের সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করলাম। কী আর দর কষাকষি! ওর যেমন পাকা ইংরেজি, আমারও তেমন ফ্রেঞ্চ! কেউ কারও কথা এক বর্ণ বুঝি না। এদিকে আমার মোবাইলের ডাটা শেষ। হোটেলের নাম কিংবা ম্যাপ কোনো কিছুই বের করতে পারছি না। পারছি না গুগল ট্রান্সলেশন দিয়ে ইংরেজি ভাষা ফ্রেঞ্চ করে একে বোঝাতে! কী মুশকিল!
মেয়েটা একটা তালিকা নিয়ে এলো কোথা থেকে! সেখানে নানান জায়গার নাম আর ভাড়া ইংরেজিতে লেখা। আমি একটা পরিচিত জায়গা পেয়ে গেলাম। নটর ডেম চার্চ। ওই চার্চ পর্যন্ত আমাকে নিয়ে গেলে বাকি রাস্তা আমি হেঁটেই যেতে পারব। ওকে নটর ডেম দেখিয়ে ভাড়া ঠিক করে উঠে পড়লাম রিকশায়।
প্যারিসের আবহাওয়া সবচেয়ে সুন্দর। সেলসিয়াসে ১২-১৩-১৪ ডিগ্রি। না, হাড় কাঁপানো শীত, না ঘাম ছুটানো গরম! এত মধুর ঠাণ্ডা পড়ে না ওখানে! কিন্তু সেদিন আমার কপালে শনিই লেখা। হঠাৎ বাতাস বইতে শুরু করল। তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমার মতো গরম দেশের মানুষের জন্য কলিজা কাঁপানো ঠাণ্ডা। ম্যাপ নেই, ইন্টারনেট নেই; শীতের ভারি পোশাক নেই। কাঁপতে কাঁপতে প্যারিসের সাইকেল লেন ধরে রিকশায় চড়ে আমি ছুটে চললাম বহুক্ষণ।
এক মোড়ে এসে মেয়েটা নেমে গেল রিকশা থেকে।
বলল, নটর ডেম চার্চ।
তখন বেশ সন্ধ্যা। চারদিকে তাকিয়ে দেখি, আমি এ রাস্তার কিছু চিনি না। এমনকি আমার হোটেল যে এলাকায়, সেই এলাকার সঙ্গে এই এলাকার কোনো মিলই নেই। বোঝাই যায় আমার হোটেল এখান থেকে বহু দূরে! এতক্ষণে আমার বুদ্ধি খুলল! মনে পড়ল আমার এলাকার নাম! মঁনপারনাস। বললাম মেয়েটাকে। মেয়েটা কোমরে হাত দিয়ে বলল, সে তো অনেক দূর এখান থেকে! তুমি তো বললে নটর ডেম! এই যে নটর ডেম।
মনে মনে নিজেকে কতই না প্রবোধ দিলাম! একা একা বিদেশে ঘুরতে এসে পথ না হারালে কি বিখ্যাত পরিব্রাজক হওয়া যায়! এই যে এখন রাত প্রায় ৯টা বাজে, কোথায় আমার হোটেল, কোথায় ওই এলাকা আর কীভাবেই বা পাব মোবাইলে ডাটা। আমাকে খুঁজে খুঁজে কী হয়রানটাই না হচ্ছে সবাই- ভাবতে গিয়ে ঠাণ্ডার মধ্যেও আমার চিকন ঘাম ছুটে গেল। অন্যদিকে মনকে বোঝালাম, আরে কী বা হবে! দেরি হবে একটু, বিপদে পড়বে আরেকটু, খুব অ্যাডভেঞ্চার হবে। ঠিকই যেতে পারব হোটেলে।
ভাড়া দিয়ে চার রাস্তার মাথায় চোখ তুলে তাকাতেই আগের চিন্তাভাবনা ভুলে গেলাম। এটা কী জিনিস আমার চোখের সামনে! মাই গড! আমি দৌড়ে রাস্তা পার হলাম। এক ছুটে গেলাম বিশাল দালানটার সামনে। এ কী অদ্ভুত কারুকাজ! দেয়ালে দেয়ালে, প্রতিটা পিলারে, গেটের প্রতি ইঞ্চিতে এ কী হাজার হাজার গল্প! এটাই নটর ডেম ক্যাথেড্রাল। এর আগের দিন যেখানে গিয়েছিলাম, সেটা সেইন্ট জারমেন চার্চ! প্যারিসের সবচেয়ে পুরনো গির্জা।
এই নটর ডেম ক্যাথেড্রাল দেখে আমার চোয়াল ঝুলে পড়ার অবস্থা। কী বিশাল, কী সুন্দর, কী দারুণ! চার্চের মাঝখানের অংশে মেরামত কাজ চলছে তখন। চারদিকে কপারের বেড়া দেওয়া দেখতে পাচ্ছি। এ চার্চ বানাতে ২০০ বছর লেগেছে। লাগবে না-ই বা কেন? এর দেয়াল, ফটকের কাজ নিজের চোখে না দেখলে, এর বিশালত্বের সামনে না দাঁড়ালে বোঝা মুশকিল, এটা এত প্রাচীন স্থাপত্য! ৮৫৬ বছর আগে তৈরি করা এ চার্চ।
আমি ফটাফট কয়েকটা ছবি তুললাম। বেশি তোলার সাহস নেই, যদি মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যায়! তখন বাড়ি ফেরায় ঝামেলা হবে। ঠাণ্ডায় আমার কলিজার যায় যায় অবস্থা। পাশে একটা ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল। নাম নটর ডেম রেস্টুরেন্ট। বাইরে লেখা ওয়াই-ফাই। আমি রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে বসলাম। মেন্যুতে খাবারের দাম দেখে চোখ কপালে! একটা ফ্রেঞ্চ অনিয়ন স্যুপ অর্ডার করে সুদর্শন ওয়েটারকে বললাম, ওহে, তোমাদের খাবারের এত দাম কেন?
সুদর্শন কাঁধ ঝাঁকিয়ে চার্চের দিকে আঙুল তাক করে বলল, কারণ এটা নটর ডেম। আরে গাধা, তোমার চারপাশে চোখ তুলে তাকাও! তুমি নটর ডেম দেখতে দেখতে খাচ্ছ! তুমি নটর ডেম এলাকায় বসে আছ! এটা কি যেনতেন ব্যাপার তোমার কাছে?
আমি বললাম, আচ্ছা বাবা আচ্ছা। এবার তোমাদের ওয়াই-ফাই পাসওয়ার্ডটা দিয়ে বিদায় হও।
ওয়েটার বলল, সরি। আজকে আমাদের নেটে ডিস্টার্ব। নো ইন্টারনেট।
হলো তো কাণ্ডটা! রাত বাজে ১০টা। আমাকে সবাই খুঁজবে। ওয়াসিম ভাইকে ফোন করে জানালাম, আমার মোবাইলে নেট না থাকায় আমি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শিগগিরই হোটেলে ফিরব। সবাইকে যেন জানায়, আমি ঠিকঠাক আছি।
মজার সেই ফ্রেঞ্চ অনিয়ন স্যুপ, যার মধ্যে কোনো রকমের পেঁয়াজের দেখা নেই। খেতে খেতে ভাবলাম, আজকে আমার কী হবে! ইন্টারনেট ছাড়া আমি কীভাবে পৌঁছাব হোটেলে! আমি যে ঠিক কত দূরে আছি, সেটাও তো জানি না! রেস্তোরাঁয় তখনও লোকজন আড্ডা দিচ্ছে, ওয়াইন খাচ্ছে আর গল্প করছে। ফ্রেঞ্চ লোকদের এই স্বভাবটা একদম আমার মতো। ধীরে ধীরে খেতে খেতে কতই না আড্ডা দেবে! আর ফ্রেঞ্চ খাবারের স্বাদ! আমি জীবনে কোথাও এত মজার খাবার খাইনি। যেমন এর স্বাদ, তেমনই দাম। অনিয়ন স্যুপের দাম ২৫ ইউরো, মানে প্রায় ২৫শ’ টাকা। চড়া মূল্য পরিশোধ করে আমার নিষ্ঠুর ওয়েটারকে ৫ ইউরো বকশিশ দিয়ে নটর ডেমের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আল্লাহ্কে ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হু হু ঠাণ্ডা বাতাস আমার পাতলা কোট ভেদ করে চামড়াসহ উড়িয়ে নেওয়ার আয়োজন করছে। ঠাণ্ডা বাতাসে আমার চোখের কোনায় পানি এসে পড়ল। কান্না না; শুধু পানি। এইচ টু ও।
এমন সময় কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে বলল, তুমি কাঁদছ?
ওমা! এ যে আমার রিকশাওয়ালি! সে এখনও এখানে! সে কোথা থেকে মোবাইলে ট্রান্সলেটর ইনস্টল করে আসছে! আমাকে ওই ট্রান্সলেটরের সাহায্যে বলল, পথ চিনতে পারছ না? হোটেলে ফিরতে পারছ না? আমি ট্যাক্সি ধরে দিচ্ছি।
আমি ওকে বললাম, তুমি কেন আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছ? পাগল মেয়ে! আমি তো পথ হারিয়ে কাঁদছি না!
মেয়েটা আমার কথা কিছুই বুঝল না। আমার ট্রান্সলেটর নেই। মোবাইলে মুখ রেখে আমাকে বলল, প্যারিসে তুমি হারানোর কোনো ভয় করবে না। হোটেলের নাম মনে না পড়লেও অসুবিধা নেই। তোমাকে মঁনপারনাস নিয়ে গেলে চিনতে পারবে তো? চিনতে না পারলেও ঘাবড়াবে না। এখানে কেউ তোমার ক্ষতি করবে না।
ও আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিল। তারপর মোবাইলে মুখ রেখে ট্রান্সলেট করে বলল, তোমার কি ট্যাক্সি ভাড়া আছে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ইয়েস।
যাওয়ার আগে ওর মাথার লাল টুপি খুলে আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে আমার গাল টিপে দিল ও।
বলল, তুমি খুব সুন্দর। একদম মডেলদের মতো পাতলা। তুমি আবার নটর ডেম এসো, প্লিজ। নটর ডেম দেখতে চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। এর ভেতরে ঢুকলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আজকের খারাপ স্মৃতিটা মনে রাখবে না। এখান থেকে ভালো একটা স্মৃতি নিয়ে যাবে। ওকে?
আমি অসহায়ের মতো মাথা নাড়লাম। বলতে চাইলাম, ওরে পাগল! আজকের স্মৃতি খারাপ তো নাই-ই বরং গল্প লেখার মতো! এত ভালো কেন ভাই তোমরা! ও মেয়ে, তোমার নামটা কী?
কিছুই বলা হলো না। আমি ওর ভাষা জানি না। আর মেয়েটাও চোখের পলকে রিকশা নিয়ে শাঁ শাঁ করে চলে গেছে। না জানি আমার জন্য কত দেরি হয়েছে ওর!
পরদিন সকাল ৭টায় আমার সুইজার?ল্যান্ড যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে। তাই নটর ডেমের ভেতর যাওয়া হলো না। আবার আসব আমি প্যারিস। তখন তোমারে ভালো করে দেখে যাব- এই বলে সেদিন বিদায় নিয়ে নিলাম এই গথিক ক্যাথেড্রালের কাছ থেকে।
যখন প্যারিস ছিলাম, দেশে তখন একের পর এক আগুন। দেশে এলাম, প্যারিসে আগুন। নিউজ মিডিয়ার লাইভ দেখলাম। সেখানেও মানুষ নানা রকম কন্সপিরেসি থিওরি আওড়াচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, এই প্রাচীন আমলের চার্চ ঠিক করার টাকা ফ্রান্স সরকারের নেই। তাই আগুন লাগিয়ে শেষ করে দিয়েছে।
ফ্রান্স সরকারের টাকার অভাব আছে, সেটা সত্যি। ইয়েলো-ভেস্ট আন্দোলন ঘেঁটে দেখলে সেটা বোঝা কঠিনও না। কিন্তু ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি ফরাসিদের যে অকুণ্ঠ ভালোবাসা, টান, দরদ আমি দেখছি; এর পর এসব কন্সপিরেসি থিওরি আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। তবে কেউ কেউ যখন প্রশ্ন করে, যে পৃথিবীতে লাখো মানুষ না খেয়ে মরে, সেখানে হাজার কোটি টাকা দিয়ে এই শিল্প রক্ষা কি খুবই জরুরি? আমি দ্বিধার সাগরে পড়ে যাই। সত্যিই তো এটা প্রাচীন ভবন, যার সাথে আমার কোনো সম্পর্কই নেই। অথচ সেটাও আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যায়! সে যখন পোড়ে ব্যথা লাগে আমারও। আটশ’ বছরের ইতিহাস, শিল্প, স্থাপত্য পুড়ে ছাই হয়ে গেল! আমি যদি নিজের চোখে এর কারুকাজ না দেখতাম, জানি না এর মর্ম আমি আসলেই বুঝতাম কি-না! তবে কোনটা জরুরি- মানুষের কোনো রকম বেঁচে থাকা, নাকি সব স্মৃতি, কীর্তিসহ মৃত্যু- আমি সত্যিই জানি না।
ছবি : লেখক, সৌজন্য – সমকাল