এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কেমন যেন একটা ইতস্তত ভাব, খানিকটা হাতড়ে বেড়াবার ভাব ছিল। এমন নয় যে আমার মনে যে ঝড় বইছে সেটা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে আমি তার সম্বন্ধে লিখব বলে ঠিক করেছি। আমি কোনো পরিকল্পনা করে নয়, অনায়াসে লেখা শুরু করি, মনে অনেক বেদনা নিয়ে, আরো কিছু বলার তাড়নায়। আরো কিছু সময় পর আমি ভাবতে লাগলাম আচ্ছা, আমি কী করছি? তখন একটু থেমে ভালোভাবে চিন্তা করলাম, আর তখনই ভাবা শুরু করলাম যে আমি যেটা করছি সেটাই লেখালিখি।
তখন উপলব্ধি করলাম যে আমি সব স্মৃতি থেকে লিখছি, আর সেসব স্মৃতি যে কী জীবন্ত আর আকুল করা, বিলেতে আমার প্রথম কয়েক বছরের অদ্ভুত অসার অস্তিত্বের সঙ্গে তার কতই না তফাত! যখন লিখতে শুরু করি, তখন আমি সেই হারানো জীবনের কথা লিখেছি, সেই হারানো স্থান, তার সম্বন্ধে যা আমার মনে আছে তাই। আবার এক অর্থে আমি বিলেতে বসবাস নিয়েও লিখছিলাম, অন্তত এমন একটা স্থান নিয়ে, যেটা আমার স্মৃতিতে, আমার অস্তিত্বে যেই স্থান, তার থেকে এতই ভিন্ন, যে স্থান আমি যে স্থান ত্যাগ করেছি তার থেকে এতটাই বেশি নিরাপদ আর দূরবর্তী যে মনটা অপরাধবোধ আর অনির্বচনীয় বেদনায় ভরে ওঠে।
ঘর থেকে অনেক দূরে গেলে মনে একটা দূরত্ব, অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়, ভাবনার পরিধি বিস্তৃত হয়, চেতনার একধরনের মুক্তি ঘটে। এর ফলে স্মৃতি আরো গভীরতা লাভ করে, আর স্মৃতিই তো লেখকের চারণক্ষেত্র। দূরত্ব লেখকের মন জঞ্জালমুক্ত করে নিজের সত্তার আরো কাছাকাছি হবার সুযোগ দেয়, ফলে তার কল্পনার স্পৃহা আরো বেশি উন্মুক্ত হয়। এই যুক্তি অনুযায়ী লেখক যেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মহাজগত্—তাকে একাকী কাজ করতে দেওয়াই সবচাইতে ভালো।
একে আপনি পুরনো আমলের যুক্তি অর্থাৎ লেখককে নিয়ে উনিশ শতকীয় রোমান্টিক আত্মাভিমান মনে করতে পারেন, তবে এরকম যুক্তির আবেদন অনস্বীকার্য, এবং সে কারণে এই যুক্তি নানারূপে এখনো টিকে আছে।
লেখকের জন্য দূরত্ব ভালো—এই কথাটা যাঁরা মানেন, তাঁদের কেউ কেউ লেখককে একটি বদ্ধ জগতে অবস্থানরত বলে কল্পনা করেন। আবার অন্যরা ভাবেন দূরত্ব লেখকের কল্পনাকে, তাঁর ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতাকে উন্মুক্ত করে দেয়। এই দ্বিতীয় যুক্তিটি এমন কথাও বলে যে এই রকম দূরত্ব, স্থানচ্যুতি প্রয়োজনীয়। লেখক সারবান লেখা তখনই সৃষ্টি করেন যখন তিনি একাকী, তখন তিনি এমন সব দায়িত্ব, নৈকট্য থেকে মুক্তিলাভ করেন যেসব তাঁর যেই সত্য উচ্চারণ জরুরি, সেই সত্যকে সংকুচিত, খণ্ডিত করে দিতে পারে।
অর্থাৎ লেখক বীর, সত্যদর্শী। স্থানের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক নিয়ে প্রথম যুক্তিটিতে যদি উনিশ শতকীয় রোমান্টিক চিন্তার অনুরণন পাই, দ্বিতীয় যুক্তি বিশ শতকের প্রথম থেকে মাঝামাঝি দশকের আধুনিকতাবাদীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইংরেজি আধুনিকতাবাদের বহু বড় লেখক বাড়ি থেকে বহুদূরে অবস্থান করে লেখালিখি করেছেন, যাতে তাঁদের রচনা আরো সত্যি আরো বিশ্বস্ত হয়। তাঁরা এমন একটা সাংস্কৃতিক আবহ থেকে নিষ্কৃতি চেয়েছেন যেটা তাঁদের দৃষ্টিতে জরাগ্রস্ত।
এর পালটা যুক্তিও রয়েছে। সেটা এরকম—অচেনা মানুষের মধ্যে একাকী থাকার ফলে লেখক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, মানুষকে বোঝা, ওদের সম্বন্ধে তাঁর উপলব্ধির প্রাসঙ্গিকতা আর গুরুত্ব, এই বিষয়ে আন্দাজটা হারিয়ে ফেলেন। বলা হয় এই উপনিবেশোত্তর যুগে যেসব লেখক প্রাক্তন ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে এসেছেন, এই কথাটা বিশেষ করে তাঁদের বেলায় প্রযোজ্য। উপনিবেশবাদ নিজেকে নীতিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বর্ণ ও উঁচু-নিচু ভেদবুদ্ধির একটি কাঠামোর ওপর নির্ভর করে—সেটা সংস্কৃতি, জ্ঞান ও প্রগতির নানান ধারণায় রূপ গ্রহণ করে। ঔপনিবেশিক শাসনাধীন অঞ্চলের মানুষকে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হয়েছে এইসব ভাবনা মান্য করাতে।
উপনিবেশোত্তর লেখকের জন্য মনে হয়, ঔপনিবেশিক শক্তির প্রচেষ্টা তাঁর ব্যাপারে সফল হয়ে থাকতে পারে, অথবা ইউরোপে একাকী অস্বাভাবিক ভিনদেশি হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও একাকিত্ব তাকে ঔপনিবেশিক ধারণার প্রতি অনুরক্ত করতে পারে। ওরকম লেখক তখন তিক্ত পরবাসী হয়ে যেতে পারেন। তখন তিনি যাদের ফেলে এসেছেন, তাদের ব্যঙ্গ করতে পারেন।
প্রকাশক ও পাঠকরা অবশ্য তার তারিফ করেন, কারণ এঁদের মনে এখনো প্রচ্ছন্ন বৈরী মনোভাব রয়ে গিয়েছে, ইউরোপ-বহির্ভূত জগতের ওপর কেউ খড়্গহস্ত হলে এরা তাকে নিয়ে মহানন্দে মাতামাতি করতে রাজি। এই যুক্তি অনুযায়ী অচেনা ভিনদেশিদের মাঝে বসবাস করে ওদের জন্য লিখতে গেলে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য লেখককে নির্মম হতে হবে, আত্মধিক্কারকে সততার মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, নতুবা লেখককে আবেগপ্রবণ অতি-আশাবাদী হিসেবে খারিজ করে দেওয়া হবে।
(সংক্ষেপিত)
(তানজানিয়া বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ প্রবাসী ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মূলত রিফিউজি ও ঔপনিবেশিকতার সমস্যা নিয়ে তাঁর একের পর এক রচনা বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের মন জয় করে। ১৯৪৮ সালে তানজানিয়ার জানজিবারে জন্ম নেওয়া গুরনাহর সাহিত্যজীবন বিকশিত হয়েছে ইংল্যান্ডে। কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুরনাহ ১০টি উপন্যাস লিখেছেন। তার মধ্যে ‘প্যারাডাইস’ উপন্যাসটি সবচাইতে আলোচিত।)