মন্দ সময়ে এক মন্দনিলা
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:২১:৩৪,অপরাহ্ন ০৩ অক্টোবর ২০২০ | সংবাদটি ৭৭১ বার পঠিত
উজ্জ্বল মেহেদী
মন বড় শক্ত মন্দনিলার। চলছিল তার শরীর নিয়ে খেলা। খেলছিল যারা, উল্লসিত তারা। বিকৃত যৌনাচারের খেলা। খাবলাখাবলি বলা যায়। সইতে না পেরে মন্দনিলার মন চলে গেল পেছনে। চলে গেল বললে ভুল হবে। ঘুরিয়ে দিল মন। এটা ছিল তার সয়ে যাওয়ার একটি কৌশলও। ছোটবেলায় দাদি নাকফুল (দাগা) দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘কাঁটা বিঁধব লো, মন শক্ত রাখিস। মনের মোড় ঘোরালেই কষ্ট সওয়া যায়!’
মন্দনিলা তার দাদির কথা ভাবছিল। তাদের যে টানাপোড়েনের সংসার, এই বিষয়টা বুঝতে মন্দনিলার সময় লেগেছিল বেশ। মাদ্রাসার পড়া, চাকরিবাকরি করতে গেলে কলেজে পড়তে হবে। মন্দনিলা মনস্থির করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু কে জানতো, পড়তে গেলে, চলতে গেলে, টাকার বেশি প্রয়োজন। কঠিন বাস্তবতায় টাকায় ভর করতে গিয়ে একদিন মন দেয়ানেয়া বেড়ে যায়। একের পর এক প্রতারিতও হতে হয়। কলেজে ‘ইয়ারচেঞ্জ’ হলে যে বেশ টাকা লাগে, সেটিও তার জানা ছিল না। মন্দনিলা ঝড়ে পড়ল কলেজ থেকে। ‘একাদশ’ সে-তো আরেক যুদ্ধ সংখ্যা। মন্দনিলাও জীবন যুদ্ধে পড়ল। আঠারোর দিকে বয়স, যুদ্ধ করে নিজেকে রক্ষা আর যথার্থভাবে হয়নি। আইএ-বিএ পাশ করে একটি শিক্ষকতা চাকরির স্বপ্নপূরণ হয়নি। স্বপ্নভঙ হওয়ার ক্ষনে বন্ধু জুটল বেশ। সুজন-কুজন বন্ধু-এই দূরমূল্যের বাজারে বোঝা বড় দায়। মন্দনিলা বুঝতে চায় না। মনও মানে না। কবি দস্তগীরের কবিতার মতো ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব বলতে গিয়ে দেখে তেঁতুল হাসি ঘিরে রেখেছে চারদিক। কী করবে মন্দনিলা? তা-না হলে যে ইভটিজিং-যাতনা বয়ে বেড়াতে হবে।
এত টুকু ভেবে পার করল মন্দ সময়টা। মন্দনিলা দেখল ঝড় থেমে গেছে। পৃথিবী এখন শান্ত। পাঠার মতো আচরণ করা এক-দুই-তিন-চারজন নির্জীব। গাড়ি থেকে নামায়। সঙ্গে থাকা টাকাও নিয়ে নেয়। ভরসা স্বামী। তারও যেন কান্না নিবারণ হচ্ছিল না। ত্রস্ত পদে পালায় দুজন। সরু পথ, সড়কবাতি এসে পড়ছিল মন্দনিলার মলিন মুখে। চারদিক অন্ধকার হলেই যেন মন্দনিলা নিস্তার পেত। তা আর হয় না। চলতি পথে একটি অটোরিকশা তাদের দেখে থামে। মন্দনিলা ভরসার মানুষটাকে নিয়ে ওঠে পড়ে অটোরিকশায়। মুখে মাস্ক। করোনার জন্য নয়, পোড়া মুখটাকে আড়াল করতে চায়। সঙ্গী ভয়ে বিচার চায় না। ঘটে যাওয়া ‘লীলা’র নিদর্শন গাড়িটা শুধু ফিরে পেতে চায়। মন্দনিলা ভাবে, বিচার হলে মন্দ না। আমি তো মন্দনিলাই। চোখ তার জল ভরা। অন্ধকারে চিকচিক করছিল। সঙ্গী কাঁদে, মন্দনিলার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে নীরবে।
ব্যস্ত রাস্তায় কে কার শুনে কান্না। কথা শুনে দৌঁড়ে পালায় সবাই। ফিরেও তাকায় না আর। বলাবলি হচ্ছিল ‘কেসটা …ব ভাইর’। উচ্চ স্বরে এ রকম কথা ঘুরেফিরে কানে বাজে। মন্দনিলা সঙ্গীসহ আরেক দফা ভরসা পায়। ঘটনা শুনে অন্যদের মতো ‘ব ভাই’ বিরক্ত নন, বরং বীরত্ব দেখান। মন্দনিলার ‘ভাই বাঁচাইন…’ আকুতি। ভাই বলে সম্মোধনে ‘ব’ ভাই যেন ‘লেগে রহো মুন্না ভাই…’। সেই ঘটনাস্থলে আবার পা রাখা মন্দনিলার। ফটকে অপেক্ষা। যদি ফিরে পাওয়া যায় গাড়িটা।
ইয়াবা-অস্ত্রসঙ্গ এক পাল পাঁঠা। আলামত নষ্ট করার চেষ্টায় আছে। চাক্ষুস দেখে ‘ব’ ভাই সংক্ষুব্ধ। তার সাগরেদ কজন জড়ো হয়। মন্দনিলা ও সঙ্গীর ভরসা ’ব’ ভাইর। আর ‘ব’ ভাইয়ের ভরসা জড়ো হওয়া লোকজন। একটু আগে লীলাখেলায় মত্ত সবাইকে চেনা হয়।এরা দেখতে সবাই মানুষ, আসলে পাঁঠা। দ্বিতীয়বার ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে মন্দনিলার এই মূল্যায়ণ। এ বার পুলিশ ডাকা হবে। মন্দনিলা মন আরও শক্ত করে। মন্দ সময়ের বিচার পেলে তো আরও ভালো। মনে মনে প্রস্তুতি নেয় মন্দনিলা। ফটকে এক পুলিশ আসা মাত্র ‘ব ভাই’ ওই পুলিশকে নিয়ে ছুটেন ঘটনাস্থলের দিকে। গাড়িটি ধুয়ে মুছে সব পাপ পরিস্কার করতে চেয়েছিল পাঁঠারা। কিন্তু পারেনি। দলবদ্ধভাবে পালাল। পুলিশ পেল নিদর্শন মানে বর্বরতার দগদগে দাগ।
এরপর একসঙ্গে সব জিজ্ঞাসা ও উত্তর মন্দনিলার দিকে তাক করা। মন্দনিলা ভাবছে, শরীর সুরক্ষিত, কিন্তু কথায় জর্জরিত হওয়ার পালা বোধহয় শুরু। অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস স্থাপনে হাতের মেহেদি দেখায় মন্দনিলা। আর তো কোনো সাক্ষী নেই তার।
আরেক দমকা হাওয়ার মুখে মন্দনিলা। এবার বিচ্ছিন্ন সঙ্গীও। কোথায় মন্দনিলা আর কোথায় সঙ্গী। কী নামে আর ডাকবে তাকে। হাতে তো মেহেদি ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই, নেই কবুল বলার দলিলটিও। আরেকবার ভরসার কাছে পরাজয়। রাতের ক্লান্তিতে ঘুম ঘুম মন্দনিলার। কিন্তু ঘুম আর আসে না। বুঝতে পারে, উদ্ধার হওয়ার পর থেকে আছে একটা ঘুমঘরে। সেখান থেকে আরেক ঘর, আরেকদফা জিজ্ঞাসা। কোনো কিছুই গোপন করেনি সাহসী মন্দনিলা।
‘যাহা সত্য তাহা বলিব…’ বলে এসে দেখে বর্তমান ঠিকানা তার এলামেলো। রাত পোহানোর আগেই সেই কালরাতের গল্প যার যার মতো করে রটে গেছে।এ পরিস্থিতিতে মন্দনিলার উপলব্দি, কারো মুখে কোনো লাগাম নেই। যে ভাইরাল ভিডিও দেখে এক সময় মজা নিত মন্দনিলা, সেই ‘ভাইরালপার্টি’ দরোজা পর্যন্ত গিয়ে কড়া নাড়ে। ‘অনুভূতি কী’ জানতে চায়। কয়জন, কোন পালায়, ঘরে না গাড়িতে, চিৎকার করেছিল কি? এসব জানতে চেয়ে সঙ্গির সঙ্গে ছবি চায়। সুজন-কুজন বন্ধু বিচারহীনতায় হেরে যাওয়া সময় তালাশ করে। ফোনালাপ শোনায়। এসব কিছুর মধ্যে ঠিকানা বদল করে দরজায় খিল্ দেয় মন্দনিলা।
তার আর পর নেই মন্দনিলার। কোনো উপলব্দিও যেন নেই। জীবন থমকে দাঁড়িয়েছে। ঘরের খিল দরজা খুলতে চায়। কিন্তু ‘রক্ষক’দের নিয়েও এখন তার বড় ভয়। মন্দনিলার জীবন বুঝি এই কুড়ি বছরেই থমকে দাঁড়াল?
বাড়ি ফিরে দরজায় খিল্ দিয়ে তিন দিন, তিন রাত কাটে। ঘরে বাবা, মা, ছোট দুই ভাইবোন আছে। সবাই যেন নিজ ঘরে কারাবন্দী। করোনাকালে ঘরবন্দী, এ যেন মহামারিকালের মধ্যে পড়েছে মন্দনিলা। সপ্তাহন্তে শরতের ঝলমল এক সকালে মন্দনিলা খবর পেল, তাকে নিয়ে খাবলাখাবলি করে খেয়েছিল যারা, তারা এসবকে জঘন্য এক অপরাধ বলে স্বীকার করে নিয়েছে।
কী কাকতাল, সপ্তাহ দিন আগে যে শুক্রবার রাতে মন্দনিলাকে লুট করেছিল পাঁঠারা, সপ্তাহ না ঘুরতেই সেই রাতের সময়ে প্রধান পাঁঠাসহ তিনজন ১৬৪ ধারায় সব স্বীকার করেছে। শুনে মনে আবার বল পায় মন্দনিলা। নাকফুলে কষ্ট সওয়ার মতো মনোবল নিয়ে আছে। কিন্তু সমাজ, আশপাশ দেখে আরেক ভাবনায় লীন। ভাবতে ভাবতে আগে অনেকবার শোনা শাহ আবদুল করিমের গান ও সুর আপ্লুত করে মন্দনিলাকে। ’আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/ আমারে কেউ ছুঁইও না গো সজনী/ প্রেম করে প্রাণবন্ধুর সনে/ যে দুঃখ পেয়েছি মনে/ আমার কেঁদে যায় দিন রজনী…’।
সুরের সূরায় মন্দনিলার অবচেতন শরীর চেতনা ফেরে, মনও কথা বলছে। মন্দনিলা তার মনকে বলে, যদি সেই রাতের ঘটনা জানিয়ে দেওয়ার পর তার কোনো খোঁজ কেউ নিত না, যদি তার তালাশ কেউ করত না, তাহলে মনের বলে বলীয়ান হয়ে বড় বাঁচা বেঁচে যেত মন্দনিলা। তারপর জীবন হয়তো তাকে পথ দেখাত।
#
পুনশ্চ : সত্য ঘটনায় এই গল্প। সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া থেকে বের করার পাশে দাঁড়িয়ে কাল্পনিক এক উপস্থাপনা মাত্র। একটি স্বাধীনচেতা মেয়ের সঙ্গে পাশবিক অপরাধে, অপরাধীদের স্বীকারোক্তিতে বিচারের পথে ক্রমে এগোচ্ছে ঘটনাটি। মেয়েটিকে যদি সুরক্ষিত রেখে অগ্রসর হওয়া যেত, তাহলে ‘কল্প’ নামে মহান এক বিচারকের ঐতিহাসিক রায়ের দ্বিতীয় আলোকচ্ছটায় আমরাও আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেতাম। তখন দেয়ালের গ্রাফিতিকে বুকে এঁকে বলতাম, ‘সুবোধ পালায় নি’। অথবা জানতে চাওয়া হতো না- ‘সুবোধ, কবে হবে ভোর?’
-উজ্জ্বল মেহেদী, সিলেট# ৩ অক্টোবর, ২০২০