যেভাবে রমজানের প্রস্তুতি নেবেন
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৪২:৩৪,অপরাহ্ন ০৩ মে ২০১৯ | সংবাদটি ৫০৪ বার পঠিত
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
প্রথমেই দরকার রমজান বিষয়ে জ্ঞানার্জন
পবিত্র কোরআনের প্রথম কথাই হলো ‘পড়ো’। ইসলামে জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে এত বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে যুদ্ধ চলাকালেও জ্ঞানচর্চার ব্যাপারে উদাসীন না হতে সতর্ক করা হয়েছে। ইমাম কুরতুবি (রহ.) লিখেছেন : এ আয়াত ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের মৌলিক দলিল। চিন্তা করলে দেখা যাবে, এতে ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাগ্রহণের পর করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। (তাফসিরে কুরতুবি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪) হাদিস ব্যাখ্যাকারদের মতে, যতটুকু জ্ঞান অর্জন না করলে একজন মানুষের তার দৈনন্দিন আমলগুলো করা সম্ভব নয়, ততটুকু জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। পবিত্র রমজান মাস আসন্ন। তাই প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিত রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল জেনে নেওয়া। কী করলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে বা মাকরুহ হয়ে যাবে, তা জানা থাকা আবশ্যক। তা ছাড়া জ্ঞান ছাড়া তো ঈমান শেখাও সম্ভব নয়। জ্ঞান অর্জন না করলে একজন মানুষ বুঝবে না যে কখন কোন কাজটি তার রহমতের আর কোন কাজটি আজাবের কারণ হতে পারে।
রমজানকে কেন্দ্র করেই জিবরাইল (আ.)-এর একটা বদদোয়া আছে, যে বদদোয়ার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘আমিন’ বলেছেন। মসজিদে নববীতে একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারের প্রথম ধাপে উঠছিলেন। জিবরাইল (আ.) বদদোয়া করে বসলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, সে আল্লাহ তাআলার রহমত থেকে দূরে সরে যাক।’ আর আল্লাহ তাআলার রহমতবঞ্চিত হওয়াটাকেই পরিভাষায় ‘গজব’ বা লানত বলা হয়। প্রতি-উত্তরে নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমিন’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! কবুল করে নিন! (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান : ১৬৬৮)
প্রয়োজনে রমজানের আগেই এ বিষয়ে কিছু পুস্তক কিনে নেওয়া যেতে পারে, যাতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও তা পড়তে পারে। এ ছাড়া নিকটস্থ কোনো অভিজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। ইতিকাফ করতে আগ্রহীদের ইতিকাফের প্রস্তুতি হিসেবে প্রয়োজনীয় মাসয়ালাগুলো জেনে নিতে হবে আগে থেকেই।
পরিবার ও গৃহিণীর রমজান প্রস্তুতি
রমজান উপলক্ষে পরিবারের প্রস্তুতিটা একটু বেশি। কেননা রমজানের অনেক কার্যক্রমের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক আছে। এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে পরিবারপ্রধান ও গৃহিণীর। মা-বাবাও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট রুটিন থাকা প্রয়োজন, যাতে কাজের কারণে ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে। একটি মুহূর্তও যেন নফল ইবাদত, তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরমুক্ত না হয়।
রমজানে স্কুলগুলো বন্ধ থাকে। এই সুযোগে কোরআন শেখা ও চর্চা করা যায়। কোনো সন্তান কোরআন তিলাওয়াত না জানলে অথবা তিলাওয়াত অশুদ্ধ থাকলে তাকে এই সুযোগে শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ মা-বাবার দায়িত্ব। এ জন্য রমজানের আগেই শিক্ষক ঠিক করে রাখা উচিত। অন্তত নামাজ পড়ার জন্য জরুরি পরিমাণ সুরা এবং নামাজের মাসায়েল ভালোভাবে শেখানো এই রমজানেই নিশ্চিত করা চাই। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই যেন রমজানে কোরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলে, সে জন্য পরিবারপ্রধান তাদের উৎসাহিত করবেন। অনৈসলামিক টিভি প্রগ্রামমুক্ত পরিবার গঠনের সিদ্ধান্তও নিতে হবে রমজান থেকে। সন্তানরা যেন ফেসবুক বা টিভিতে অযথা সময় নষ্ট না করে ইবাদতে মনোযোগী হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আর রমজানের জন্য সংযমী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে রজব ও শাবান মাসের মধ্যেই। সাহরি ও ইফতার ব্যবস্থাপনা নিশ্চয়ই সওয়াবের কাজ। তবে এগুলোতে লিপ্ত থেকে যেন নিজের ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকে প্রত্যেক গৃহিণীর খেয়াল রাখা উচিত। কঠিন কোনো কাজ রমজানের জন্য ফেলে না রেখে আগে থেকেই এমন একটি পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে সংসারের কাজ কিছুটা কমিয়ে সময় বের করে হলেও কিছু সময় কোরআন তিলাওয়াতের জন্য বরাদ্দ রাখা যায়। কিছুতেই যেন ফরজ নামাজ, তারাবি ছুটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংযমের মাসে প্রত্যেক গৃহিণীর উচিত অপব্যয় ও অপচয় পরিহার করে পরিবারের অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে তা দান-সদকায় ব্যয় করার ক্ষেত্রে স্বামীকে সহযোগিতা করা।
ব্যবসায়ীদের রমজান প্রস্তুতি
রমজান অর্জনের মাস। কেউ পুণ্য অর্জন করে, আর কেউ সম্পদ অর্জন করে। রমজান এলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিতে থাকে মুনাফাখোরির। সংযমের মাসে তারা অসংযমী হয়ে ওঠে। তাই প্রতি রমজানে দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ বাড়ে। পবিত্র মাহে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা বাড়ে। এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী কালোবাজারি, মজুদদার ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বাজারপ্রক্রিয়া রক্ষার জন্য ইসলাম মজুদদারি, মুনাফাখোরি ও প্রতারণা নিষিদ্ধ করেছে। অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্য মজুদ করাকে ইসলাম অবৈধ ঘোষণা করেছে। হানাফি মাজহাব মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করা মাকরুহ তাহরিমি (হারাম সমতুল্য)। অন্য মাজহাব মতে, এটি হারাম। কেননা এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং বহু মানুষ দুর্ভোগে পতিত হয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২০৩৯৬)। আল্লামা ইবনে হাজর হাইতামি (রহ.) গুদামজাত করে মূল্যবৃদ্ধি করাকে কবিরা গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেন। (নিহায়াতুল মুহতাজ : ৩/৪৫৬)
সাধারণ ভোক্তাদের জিম্মি করে বিত্তশালী হয়ে গেলেও কোনো লাভ নেই। এই সম্পদ দুনিয়ার জীবনেই অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৩৮)
মজুদদারি না করে সৎ নিয়তে ব্যবসা করা ইবাদত। এমন ব্যক্তির উপার্জন আল্লাহ তাআলা বরকতময় করে দেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর পণ্য মজুদকারী অভিশপ্ত হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫৩)
মহানবী (সা.) মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মদিনায় ইসলামসম্মত বাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বনু কায়নুকা গোত্রের ওই বাজার পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। বাজারটির বৈশিষ্ট্য ছিল—সেখানে কোনো ধরনের প্রতারণা, ঠকবাজি, ওজনে কম করা বা পণ্যদ্রব্য মজুদ করে মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে কষ্ট দেওয়ার সুযোগ ছিল না। মহানবী (সা.) একদিন এক বিক্রেতার খাদ্যের স্তূপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর হাত ওই খাদ্যের স্তূপে প্রবেশ করান। এতে তাঁর হাত ভিজে যায়। তিনি অনুপযুক্ত (ভেজাল) খাদ্যের সন্ধান পান। তখন রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১০২)
মূলকথা হলো, একজন ব্যবসায়ীর উচিত রমজানকেন্দ্রিক এমন একটি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা, যেন তার ব্যবসা তাকে নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত থেকে বিরত রাখতে না পারে, আর তার ব্যবসাও যেন ইবাদতে পরিণত হয়।