করোনার এই সময়ে শবে বরাত পালনে করণীয়
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:২৪:৪২,অপরাহ্ন ০৯ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ৪৭৬ বার পঠিত
মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
প্রাণঘাতি করোনার বিস্তারের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক শবে বরাত উদযাপন করতে যাচ্ছি আমরা। উপমহাদেশে মুসলিমদের ধর্মীয় যেসব উৎসব রয়েছে এর মধ্যে শবে বরাত সবচেয়ে বেশি জাকজমকপূর্ণ।
দুই ঈদের পরে এটি যে সব চেয়ে বড় উৎসব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শবে বরাত একটি উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। অথচ উৎসবের ব্যাপার ছিল না। রাতটি ছিল ইবাদতের।
ইবাদতের ভেতর উৎসবের মত আনন্দ থাকলেও এটাকে উৎসব বলা যায় না। ইবাদত হচ্ছে নিজেকে মহান সৃষ্টিকর্তার সমীপে সমর্পন এবং নিজের চরম দীনতা প্রকাশ।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এরচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ রাত শবে কদর ও আরাফার রাত। কিন্তু উদযাপনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতটি। এছাড়া ১২ রবিউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে পুরো রবিউল আউয়ালে চলতে থাকে নানান আয়োজন।
বিশেষ এক রাত হিসেবে শবে বরাতের মত এত ভিড় মিলাদুন্নবীর রাতেও হয় না। ১২ রবিউল আউয়াল সারা রাত জেগে থাকার সংস্কৃতি এখনও চালু হয়নি। একযোগে সারা দেশ সরগরম থাকা লাইলাতুল বরাতেরই কপাল লিখন।
হালুয়া রুটি বানানো, কবর জেয়ারত, গরিব মিসকিনদের সদকা করা এবং নানান আয়োজনে সাজানো থাকে ১৫ শাবানের রাত। পরদিন রোজা রাখার মাধ্যমে ইবাদতের পূর্ণতা পায়। যারা একটু বেশি দ্বীনদার ধার্মিক তারা হয়ত আগে পরে আরো দুদিন রোজা রাখার চেষ্টা করেন।
করোনাভাইরাসের চতুর্থ স্তরে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। সামনে যে আরও কত ভয়াবহ সময় আমাদের অপেক্ষা করছে সে খবর আমরা কেউ জানি না। আমরা কেবলই ভালো কিছুর আশা করছি।
আমাদের আশানুরূপ পরিস্থিতিই যে আমাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছে না। অনেকেই আশা করছেন রমজানের আগে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন করোনার পরীক্ষা থেকে।
৭৪৯ হিজরির মহামারির সময়েও বিশ্বের মুসলিমরা এমন আশা করেছিল। কিন্তু দেখা গেল রমজানে মানুষের মৃত্যুহার আরও বেড়ে গিয়েছে।
প্রতি বছর শবে বরাতের পর থেকেই মসজিদগুলো প্রস্তুত হয় রমজানের তারাবির জন্য। এবার দেখা যাচ্ছে ফরজ নামাজও রমজানের পড়া হবে কি না মসজিদে সে বিষয়েও শঙ্কিত সবাই। সব কিছু নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর।
এমন দুর্যোগের ভেতরও থেমে নেই স্যোশাল মিডিয়ায় ধর্ম নিয়ে বিতর্ক। শবে বরাতের পক্ষে বিপক্ষে বিতার্কিকরা নেমে পড়েছেন মাঠে। যার যা মনন দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে উঠেছে কোনো দুর্যোগের কারণে তা সহসা পরিবর্তিত হতে পারে না। যা আশা করা যায় তা হচ্ছে প্রত্যেকের অবস্থানে যে কঠোরতা ছিল সেখান থেকে কিছুটা সরার সম্ভাবনা।
অন্যান্য বিষয়ের মত ইসলামে শবে বরাত নিয়েও ভারসাম্যপূর্ণ যে কথাটি রয়েছে তা-ই মূলত অধিক নিরাপদ। শবে বরাতের পক্ষে বিপক্ষে দু দল যে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সেখান থেকে একটু নড়লেই কিন্তু আর কোনো বিতর্ক থাকে না।
মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন মধ্যমপন্থী। ইরশাদ হয়েছে, এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসূল তোমাদের জন্য স্বাক্ষীস্বরূপ হবে। [সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৩]
পুরো মানবজাতির পথপ্রদর্শক হতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে আমাদের। শবে বরাত বিষয়ে আমাদের চিন্তা শুদ্ধ করে নিয়ে আমরা শুদ্ধতার পথে চলা আরম্ভ করতে পারি।
একদিকে আছে শবে বরাত নিয়ে বাড়াবাড়ির মানসিকতা। অন্যদিকে অস্বীকার করার প্রবণতাও দেখা যায় অনেকের ভেতর। অথচ স্পষ্ট হাদিসে এ রাতের ফজিলতের কথা রয়েছে। আছে প্রথম যুগ থেকে বরাতের রাতে ইবাদত করার ঐতিহ্য।
অবশ্য সহি হাদিসে রাতটির নাম লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান। শাবানের মধ্য রাত। শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত।
বরাত নামকরণ আমাদের উপমহাদেশের সৃষ্টি বলে মনে করে অনেকে। বিষয়টি সঠিক নয়। আরবেও লাইলাতুল বারাত নামের প্রচলন রয়েছে। বারাআত শব্দের অর্থ হলো মুক্তি। পাপ মুক্তি। এ রাতে আম্মাজান আয়েশার (রা.) বর্ণনায় পৃথিবীবাসীর পাপ মোচনের সুসংবাদ রয়েছে।
আম্মাজান আয়েশা বলেন, এক রাতে আমি নবীজীকে আমার পাশে খুঁজে পেলাম না। নবীজীকে খুঁজতে বের হয়ে দেখলাম তিনি জান্নাতুল বাকি গোরস্থানে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করছেন।
নবীজী (সা.) আয়েশাকে বললেন, আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের ১৫ তারিখের এ পবিত্র রাতে প্রথম আকাশে নেমে আসেন তারপর কালব গোত্রের মেষপালের পশমের সংখ্যা পরিমাণ মানুষের গুনাহ মাফ করেন। [তিরমিযি, ইবন মাজাহ, আহমাদ]
বাংলা ভাষায় বরাত ভাগ্য বা নিয়তি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর মূল ফার্সি থেকে হলেও আরবি ভাষায় এর কাছাকাছি অর্থ রয়েছে। ইবনু হাজার আসকালানীর শিষ্য শিহাবুদ্দিন হিজাযির (মৃ. ৮৭৪ হি.) (রহ.) তুহফাতুল ইখওয়ান গ্রন্থে শবে বরাতকে লাইলাতুল কিসমত নামকরণের ধারা দেখতে পাই।
কিসমত অর্থও ভাগ্য। ভাগ্য বণ্টনের রাত নামকরণের উপমহাদেশীয় রীতির পেছনে আরবের প্রাচীন ঐতিহ্য দেখা যায়।
হজরত আলি রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত সমাগত হলে তোমরা সারা রাত ইবাদত কর আর দিনের বেলা রোজা রাখ। কারণ আল্লাহ এ রাতের প্রথম অংশেই প্রথম আকাশে এসে বান্দাদের ডাকতে থাকেন; আছ কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমার কাছে ক্ষমা চাও আমি ক্ষমা করে দিব, আছ কোনো রিযিক প্রার্থনাকারী আমার কাছে রিযিক চাও আমি তোমাদের রিযিক দিব। [ইবন মাজাহ, বাইহাকি]
এ রাতে ভাগ্য বণ্টনের ব্যাপারে আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকেও হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আয়েশা বলেন, আমি দেখেছি রাসূল (সা.) শাবান মাসে বেশি রোজা রাখেন, তো আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে রাসূল (সা.) বলেন, এ মাসেই মালাকুল মউতের জন্য পুরো বছরে যারা মৃত্যুবরণ করবে তাদের নামের তালিকা করা হয়, আমি পছন্দ করি আমার নামের তালিকা যখন তৈরি করা হবে তখন যেন আমি রোজা অবস্থায় থাকি।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, শাবান মাস থেকে শাবান মাস পর্যন্ত জন্ম মৃত্যু লেখা হয় এমনকি একজন বিবাহ করে ও তার সন্তান হয় অথচ মৃতদের নামের তালিকায় তার নাম লেখা হয়ে গেছে। [বিস্তারিত আলোচনার জন্য ইবন রজব হাম্বলি রচিত লাতায়েফুল মাআরিফ ২৮৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য]
শবে বরাতের ফজিলত লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টিনের ভেতরও আমরা অর্জন করতে পারি। বিদগ্ধ মুসলিম মনীষীদের মতে মসজিদের চেয়ে ঘরে ইবাদত করাই উত্তম।
করোনাভাইরাসের সময়ে বাধ্য হয়েই যখন ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে, আসুন ঘরের ভেতর রাত্রি বেলায় কিছু ইবাদত বন্দেগি করি। নিজেদের পাপ মোচন করার সুযোগ গ্রহণ করি আর সারা বিশ্বের মানুষের জন্যই দুয়া করি।
আল্লাহ দ্রুতই আমাদেরকে করোনা থেকে রক্ষা করেন। পুরো বিশ্ববাসীকেই নাজাত দেন। আমীন।
লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ ও খতিব, মসজিদে মদীনা, বাড্ডা, ঢাকা।