সুহেল ইবনে ইসহাক, টরন্টো,কানাডা
রমজান মাসে রোজাদারের কাছে প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দের। কারণ এ মাসে আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের বারিধারা পৃথিবীতে বর্ষিত হয় সারাদিনের উপবাসের ক্লিষ্ট যাতনার অবসানে যখন ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন আর তার সয় না। দিনের শেষে ইফতারের অপেক্ষা করা সত্যি এক অদ্ভুত আনন্দের মাত্রা জোগান দেয় রোজাদারদের। ইফতারের সময় রোজাদার অপার প্রশান্তি অনুভব করে থাকেন এবং ইফতারের পর মনোদৈহিক ও আধ্যাত্মিক তৃপ্তির এক অনাবিল সুখানুভূতিতে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান বলে মনে করে থাকেন। রমজানের পাঁচটি সুন্নতের দ্বিতীয়টি হলো ইফতার। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, “আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার বেশি প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে” (তিরমিজি শরিফ, আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬০, পৃষ্ঠা: ১৩১)।
ইফতার শব্দটি আরবি ‘ফাতর’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ভঙ্গ করা বা ছিঁড়ে ফেলা। এখানে ‘ফাতর’ যে অর্থ প্রদান করে, তা হচ্ছে এমন খাদ্য যা দ্বারা রোজা ভঙ্গ করা হয়। আরবি শব্দ ইফতারের অর্থ হলো রোজা ত্যাগ করা। একজন রোজাদারের যথাসময়ে ইফতার করা একান্ত প্রয়োজনীয়। সারাদিন রোজা পালন করে যথাযথভাবে সময়মতো ইফতার করার গুরুত্ব অত্যধিক। সূর্যাস্তের পর বেশি দেরি না করে ইফতার করা উত্তম। বৈধ কারণ ছাড়া বিলম্বে ইফতার করা মকরুহ। ইফতারের কিছুক্ষণ আগে থেকে খাদ্যসামগ্রী সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা সুন্নাত। কারণ, এ সময়ে মানুষ খুবই ক্ষুধার্ত থাকে এবং একমাত্র আল্লাহর ভয়ে খাবার সামনে হাজির থাকা সত্ত্বেও মুখে তোলে না। এতে আল্লাহ খুব খুশি হন। কারণ, ইফতারের সময়টা হলো বিনয় ও আল্লাহর জন্য ধৈর্য্য ধারণের চরম মুহূর্ত। এ সময় জাহান্নাম থেকে মুক্তিদানের মুহূর্ত। নিজে ইফতার করার পাশাপাশি অন্যকে ইফতার করানোর মধ্যে প্রচুর সওয়াব ও বরকত নিহিত রয়েছে। রোজাদার নিজেও ইফতার করবে এবং সম্ভব হলে অন্যকেও এতে শরিক করবে।
বিশিষ্ট সাহাবি হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে, ওই রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন: পানিমিশ্রিত এক কাপ দুধ বা একটি খেজুর অথবা এক ঢোঁক পানি দ্বারাও যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও সেই পরিমাণ সওয়াব দান করবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে আহার করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে আমার “হাউজে কাউসার” থেকে এমন পানীয় পান করাবে, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না।
মুমিনগণ ইবাদতে আনন্দ লাভ করেন। মহানবী (সা.) বলেছেন: রোজাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। সূর্যাস্তের পর রোজাদার প্রথম যে পানাহারের মাধ্যমে রোজা ছাড়ে, তাকে ইফতার বলে। ইফতার অর্থ ভাঙা বা উপবাস ভঞ্জন করা। ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা উত্তম। ইফতারের আগেই ইফতার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা এবং যথাসময়ে ইফতার করা সুন্নত। ইফতার সামনে নিয়ে যে দোয়া করা হয়, সেই দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।
যায়েদ ইবনে খালেদ আল-জুহানি (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সে রোজাদারের সম পরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না।”[সুনানে তিরমিযি (৮০৭), সুনানে ইবনে মাজাহ (১৭৪৬), ইবনে হিব্বান তাঁর সহিহ গ্রন্থ (৮/২১৬) এ এবং আলবানি তাঁর ‘সহিহ আল-জামে’ গ্রন্থ (৬৪১৫) হাদিসটিকে ‘সহিহ’ বলেছেন।
ইফতার অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হওয়া উচিত: এক, ইফতার করা ও করানোর মাধ্যমে সওয়াব লাভ করা; দুই, দ্বীনি তালিম; তিন, ইসলামি তাহজিব তমুদ্দুন ও সংস্কৃতির বিকাশ; চার, গরিবদের আর্থিক ও সামাজিক
সহযোগিতা করা। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদতই কবুল হয় না। হালাল খাদ্য ও হালাল উপার্জন রোজা, নামাজ ও যাবতীয় ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। তাই ইফতার ও সাহ্রিতে বৈধ উপার্জনের হালাল খাবার চাই।
সলফে সালেহিন খাবার খাওয়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন এবং তাঁরা এটাকে মহান ইবাদত মনে করতেন।
জনৈক সলফে সালেহিন বলেছেন: “দশজন সাথীকে দাওয়াত দিয়ে তাদের পছন্দসই খাবার খাওয়ানো আমার কাছে দশজন গোলাম আজাদ করার চেয়ে প্রিয়।” সলফে সালেহিনের অনেকে নিজের ইফতার অন্যকে খাওয়াতেন। এদের মধ্যে রয়েছেন- ইবনে উমর, দাউদ আল-তাঈ, মালিক বিন দিনার, আহমাদ ইবনে হাম্বল। ইবনে উমর এতিম ও মিসকীনদের সঙ্গে না নিয়ে ইফতার করতেন না।সলফে সালেহিনদের কেউ কেউ তাঁর নিজের ইফতার তার সঙ্গী সাথীদেরকে খাওয়াতেন এবং নিজে তাদের খেদমত করতেন। এদের মধ্যে অন্যতম- ইবনুল মুবারক।আবু সাওয়ার আল-আদাওয়ি বলেন:
“বনি আদি গোত্রের লোকেরা এই মসজিদে নামায পড়ত। তাদের কেউ কখনো একাকী ইফতার করেনি। যদি তার সাথে ইফতার করার জন্য কাউকে সাথে পেত তাহলে তাকে নিয়ে ইফতার করত। আর যদি কাউকে না পেত তাহলে নিজের খাবার মসজিদে নিয়ে এসে মানুষের সাথে খেত এবং মানুষকেও খেতে দিত।“
খাবার খাওয়ানোর ইবাদতের মাধ্যমে আরও অনেকগুলো ইবাদত পালিত হয়: নিমন্ত্রিত ভাইদের সাথে হৃদ্যতা ও ভালবাসা। যে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা জান্নাতে প্রবেশের কারণ। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা ঈমান আনা ছাড়া জান্নাত যেতে পারবে না। আর পারস্পারিক ভালোবাসা ছাড়া তোমাদের ঈমান হবে না।”[সহিহ মুসলিম (৫৪)] দাওয়াত খাওয়ানোর মাধ্যমে নেক লোকদের সাহচর্য অর্জিত হয় এবং আপনার খাবার খেয়ে তারা নেককাজের শক্তি পায়, এতে আপনার সওয়াব হয়।
তাই আসুন আমরা যেন সামর্থ অনুযায়ী গরিব, অসহায়, নিঃস্ব লোকজনদের সাথে নিয়ে ইফতার করি।সামর্থ অনুযায়ী আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিয়ে ও ইফতারের মতো ফজিলতপূর্ণ কার্যটি সম্পাদন করি। কোনো প্রথা বা অপসংস্কৃতি যেন এই মহিমান্বিত ইবাদত টিতে স্পর্শ না করে।
হাদিসে আছে: “সে পর্যন্ত দ্বীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে, যে পর্যন্ত মানুষ শিগগির ইফতার করবে। কেননা ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বিলম্বে ইফতার করত। ইফতার শুধু খাদ্য গ্রহণের নাম নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হজরত সাহল ইবনে সাআদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: যত দিন লোকেরা ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, তত দিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে।(বুখারি, সওম অধ্যায়, হাদিস: ১৮৩৩)।
“ইফতার” কে প্রথা বা কুসংস্কার বলে এর মাহাত্ম্যকে খাটো করার কোনো অবকাশ নেই। পুরুষ শাসিত সমাজে, অজ্ঞতার সমাজে অনেক অপসংস্কৃতি গজিয়ে উঠেছে, কুসংস্কারে গা ভাসাচ্ছে অনেকেই।একটি কথা উল্লেখ করা যুক্তিসঙ্গত মনে করি, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, এতে অসাম্যের কোনো রেশ নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রমজানের কিংবা অন্য কোনো দিনে কার্টুন ভর্তি করে ইফতার প্রদানের কোনো যৌক্তিকতা ইসলাম ধর্মে নেই। এতে খাবারের অপচয় বাড়ে। সামাজিক অসাম্যের রেশও দেখা দিতে পারে। যদি সওয়াবের মনোভাব নিয়ে কেউ আত্মীয়তা রক্ষা করতে সামান্য পরিমাণ ইফতার সামগ্রী কারও বাড়িতে নিয়ে যান, এতে অসুবিধার কিছু দেখা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় রমজান মাসে আত্মীয়ের বাড়িতে ইফতারি প্রদানের নামে বর্তমানে যেন নিয়ম চালু রয়েছে। মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে কার্টুন বোঝাই ইফতার পাঠানো, এসব ইসলামের নামে অপসংস্কৃতি ছাড়া কিছু নয়। এই প্রথায় ধনী পিতার সাময়িক আমোদ ও আদরের মেয়ের প্রতি ভালবাসা মনে হলেও ইফতারি প্রদানের তৈরি ট্রেন্ডের জন্য বা অত্যাচারিত হচ্ছেন সে-সব দরিদ্র বাবা, অন্যের দেখাদেখি বাধ্য হয়ে মেয়ের সুখের জন্য ধারদেনা করে রেওয়াজগুলো মানতে বাধ্য হচ্ছেন। গরিব পিতা কার্টুন বোঝাই ইফতারি পাঠাচ্ছেন মেয়ের স্বামীর বাড়িতে মেয়ের সুখের জন্য। নিভৃতে তারা অত্যাচারিত হচ্ছেন। সুতরাং, ইসলামের নামে এসব বাড়বাড়ন্তে সওয়াবের পরিবর্তে গোনাহগার হওয়ার আশঙ্কা অবজ্ঞা করা যায় না। তাই আমাদের এসব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন মনে করি। কারণ, কুরআন ও হাদিসবহির্ভূত কোনো কিছু ইসলাম গ্রহণ করে না আর এসব নিঃসন্দেহে সামাজিক অসাম্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়।
“যৌতুক” এরকম একটি ঘৃণ্য প্রথা, এই আলোচনায় যৌতুক নিয়ে কথা বাড়াচ্ছিনা , “ইফতারি” প্রসঙ্গে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
জোরপূর্বক কিংবা ছলে-বলে, কথার কৌশলে, পুরুষ শাসিত সমাজে সামাজিক নির্যাতনের দ্বারা ছেলের শশুরবাড়ি থেকে ইফতারি দিতে বাধ্য করাকে আমি যৌতুকের সাথে সমান করে দেখতে চাই, যা কুসংস্কার ও সামাজিক ব্যাধি । যা বন্ধকল্পে আপনাকে, আমাকে সোচ্চার হতে হবে, সচেতনতার সহিত এই সামাজিক সমস্যা কে সমাজ থেকে উৎখাত করতে হবে। অধিকহারে ইসলামী জ্ঞান আহরণ করতে হবে, লব্ধ ইসলামিক জ্ঞানের বাস্তবিক প্রয়োগ ব্যবহারিক জীবনে নিশ্চিত করতে হবে, সর্বোপরি মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে ।
কেউ কেউ ইফতারি করানোকে প্রথা, কুসংস্কার আখ্যায়িত করেছেন ।ইফতারের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই এও বলতে শুনি। এবং ইফতরী বন্ধ করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন । যা একজন মুসলমান হিসেবে আমার পীড়ার কারণ।
“শশুর বাড়ির ইফতারকে না বলুন” কেন, কার শশুরবাড়ি? হ্যাঁ যৌতুক, কুসংস্কার ও সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাদের সরে আসতে হবে, কিন্তু যদি ইসলামের সুমহান এই ফযীলতকে হৃদয়ে ধারণ করে মেয়ের শশুর বাড়ি হতে, কিংবা মেয়ের শশুর বাড়ির লোকেরা আমরা যারা আছি আজ থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী বাধ্যবাধকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে ছেলের শশুর বাড়িতে, নিজের আত্মীয় হিসেবে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে ইফতারি দেয়া শুরু করেন, তাহলে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হবে, সামাজিক প্রথাও চূর্ণ হবে ।প্রথার সাথে সুমহান এই ইফতারকে যেন আমরা গুলিয়ে না ফেলি। মাথা ব্যথা হলে ব্যথা সারাতে হবে মাথা কেটে ফেলা নয় ।কথা গুলো আমার উপলব্ধি থেকে বলা, ইসলামি চিন্তাবিদগণ সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। আর আমার উপলব্ধি থেকে বলা কথা গুলোর সাথে যে কারও ভিন্নমত থাকা স্বাবাবিক। ভিন্নমত পোষণকারীকে আমি মূল্যায়ন করি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনাকে-আমাকে সঠিকভাবে ইসলামকে বুঝার, এবং সে অনুযায়ী আমল করার সক্ষমতা দান করুন। আমিন ।।
সুহেল ইবনে ইসহাক : কবি ও কলাম লেখক , টরন্টো কানাডা।