৪৭ বছরের সম্পর্কের অবসান ব্রিটেনের
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:১৩:৫৩,অপরাহ্ন ০২ মে ২০২০ | সংবাদটি ৫১৬ বার পঠিত
তৃতীয় বাঙলা ডেস্কঃ
‘নতুন কিন্তু অনিশ্চিত’ এক অধ্যায়ের সূচনা হলো ইউরোপে। গতকাল শুক্রবার স্থানীয় সময় মধ্যরাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় (ব্রেক্সিট) কার্যকর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ব্রিটেনের ৪৭ বছরের সম্পর্কের অবসান ঘটল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই বিচ্ছেদকে ‘নতুন ভোর’ আখ্যায়িত করে দেশে ঐক্য স্থাপন ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান তিন নেতাও একে ‘নতুন ভোর’ বলে অভিহিত করেন। ব্রিটেনে ব্রেক্সিটপন্থী নেতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ এর বিপক্ষে থাকায় তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে আড়ম্বরপূর্ণভাবে দেশটিতে ব্রেক্সিট উদ্যাপন হচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার ঘড়ির কাঁটা ব্রিটেন সময় রাত ১১টায় ((বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা) পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক্সিট কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিদায় নেওয়া প্রথম রাষ্ট্র হলো ব্রিটেন।
এর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি অনুমোদন দেওয়ার পর সর্বশেষ গত বুধবার ইইউ পার্লামেন্টও চুক্তিটিতে অনুমোদন দেয়, যা ৩১ জানুয়ারি মধ্যরাতে কার্যকর হবে বলে আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে কাল রাত থেকে ব্রেক্সিট কার্যত কাগজে-কলমে কার্যকর হয়েছে। বাস্তবে কার্যকর হবে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর। আগামী ১১ মাসকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সময়’ হিসেবে ধরা হয়েছে, যাকে ‘১১ মাসের টেনশন’ বলে অভিহিত করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যম।
ব্রেক্সিট কার্যকরকে সামনে রেখে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তাঁর এই ভাষণ রেকর্ড করে রাখা হয়েছে, যা ব্রেক্সিট কার্যকরের এক ঘণ্টা আগে সম্প্রচার করার কথা। রেকর্ড করা ভাষণে তিনি বলেন, ‘সরকার হিসেবে আমাদের কাজ হচ্ছে, আমার কাজ হচ্ছে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা, যা আমাদের সামনে এগিয়ে নেবে।’
ব্রেক্সিট বাস্তবায়নকে সামনে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তিন প্রধান ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন দার লিয়েন ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্ট দাভিদ সাসোলি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, শুক্রবার হচ্ছে ইউরোপের জন্য নতুন ভোর। একই সঙ্গে তাঁরা লন্ডনকে সতর্ক করে দেন, ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার পর দুই পক্ষের অংশীদারি কেমন হবে তা নির্ভর করবে ভবিষ্যতে (অন্তর্বর্তী সময়ে) কী সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পরও সহসা কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। কারণ ব্রেক্সিট চুক্তিতে ১১ মাসের অন্তর্বর্তী সময় (ট্রানজিশনাল পিরিয়ড) রাখা হয়েছে। ফলে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ইইউর বাণিজ্য ও ট্যারিফ সংক্রান্ত সব আইন ও বাধ্যবাধকতা মেনে চলবে। তবে জোটবদ্ধ থাকলেও ইইউ থেকে কোনো সুযোগ পাবে না। ব্রিটেন ইইউতে কোনো ধরনের প্রতিনিধিত্বও করতে পারবে না। এ সময়ের মধ্যে দুই পক্ষ ভবিষ্যৎ চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, এর অর্থ এই নয় যে, ব্রিটেন ১১ মাস পর ফিরে আসতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে আইনগতভাবে ব্রিটেনের বিদায় ঘটে গেছে এবং ফিরে আসা মোটেও সহজ হবে না। এ সময়ের মধ্যে অবশ্যই দুই পক্ষের ভবিষ্যৎ চুক্তি করতে হবে।
ব্রিটেনে বিভাজন : ২০১৬ সালে এক গণভোটে ব্রিটিশ নাগরিকরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার (ব্রিটিশ এক্সিট, সংক্ষেপে ব্রেক্সিট) পক্ষে রায় দেয়। তখন গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তখন থেকেই ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যে রাজনীতিকদের মধ্যে তিক্ততা ও বিভক্তি দেখা দেয়। ফলে জাতীয় ঐক্য পুনঃস্থাপন তাঁর জন্য এক চ্যালেঞ্জের বিষয় এবং জরুরিও। সেই দিকটি সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী জনসন তাঁর রেকর্ড করা ব্রেক্সিট ভাষণে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা ও সমৃদ্ধির নতুন যুগ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের বিভাজন দেখা যায় গণমাধ্যমেও। ইউরোসেপটিক (ইইউবিরোধী) ট্যাবলয়েড পত্রিকা দ্য সান গতকাল প্রথম পাতাজুড়ে শিরোনাম ছিল ‘আওয়ার টাইম হেজ কাম’ (আমাদের সময় হাজির)। ইইউপন্থী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের শিরোনাম ছিল ‘স্মল আইল্যান্ড, বিগেস্ট গ্যাম্বল ইন এ জেনারেশন’ (ক্ষুদ্র দ্বীপ, প্রজন্মের বিশাল জুয়া)।
ব্রিটেনে উদ্যাপনেও দেখা গেছে বিভাজন। সরকারিভাবে নিঃশব্দে ব্রেক্সিট উদ্যাপন করা হচ্ছে। ব্রেক্সিট উদ্যাপনের অংশ হিসেবে ৫০ পেন্সের ৩০ লাখ ব্রেক্সিট স্মারক কয়েন (ধাতব মুদ্রা) বাজারে ছাড়া হয়েছে, যাতে ‘৩১ জানুয়ারি’ লেখা রয়েছে। উদ্যাপনের অংশ হিসেবে গতকাল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক করেন সান্ডারল্যান্ডে, যেখানে ২০১৬ সালের গণভোটে প্রথম ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দেয়ালে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়।
‘ব্রেক্সিট পার্টির’ নেতা নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বে ব্রেক্সিটপন্থীরা গতকাল রাতে ব্রেক্সিট উদ্যাপন করতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চত্বরে জড়ো হয়। তারা ঘড়ির কাঁটায় ‘ক্ষণগণনা’ করে ইইউকে বিদায় জানায়। এ ছাড়া হোয়াইট হল সড়কজুড়ে ভবনগুলোতে রঙিন বাতি জ্বলে ওঠে এবং পার্লামেন্ট ভবনের প্রতিটি কোণ থেকে ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় পতাকা উড়ানো হয়। তবে ইইউর পক্ষে থাকা ব্রিটিশ নাগরিকরা গতকাল স্থানীয় সময় রাত ৩টায় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ‘আবেগী বিদায়’ জানাতে লন্ডনে সমবেত হয়।
বিপরীত দিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসেও আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। রাত ১১টার পরপরই ইইউর প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুক্তরাজ্যের পতাকা সরিয়ে ফেলা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এসব ব্রিটিশ পতাকা ইইউ জাদুঘরে পাঠানো হবে। সূত্র : এএফপি, বিবিসি।