রূপের রানী দার্জিলিংয়ে
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৩৭:৫৩,অপরাহ্ন ১৪ মে ২০১৯ | সংবাদটি ৮১৪ বার পঠিত
আল ফাতাহ মামুন
মনকাড়া কিংবা মনভোলা যাই বলি না কেন দার্জিলিংয়ের অপরূপ সৌন্দর্য লেখার সাধ্য আমার নেই। শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০ রুপি অটো ভাড়া দিয়ে দার্জিলিং মোড় আসি।
এখানে এসে দাঁড়ালেই আমাদের দেশের সিএনজি ড্রাইভারদের মতো জিপ ড্রাইভাররা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। কোথায় যাবেন! দার্জিলিং! দার্জিলিং! এক নেপালি ড্রাইভারের সঙ্গে দরদাম ঠিক করে উঠে পড়ি তার গাড়িতে। নেপালিরা যে জাতি হিসেবে কতটা রসিক এবং ফুরফুরে যাত্রাপথে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং তিন-চার ঘণ্টার পথ। পুরোটা সময় যেন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে দেখে যেতে পারি তাই জানালার পাশেই বসেছি। আমার পেছনে বসেছে সফরসঙ্গী আমার ভাই রবিউল। আর পুরো জিপে তিনজন মেয়ে দু’জন ছেলে। তাদের বাড়ি দার্জিলিং জেলাতেই। এ প্রথম দার্জিলিং ঘুরতে যাচ্ছেন ওরা!
‘বিশ্বজোড়া পাঠশালার’- কবি সুনির্মল বসু বলেছিলেন, ‘পাহাড় শিখায় তাহার সমান-/হই যেনো ভাই মৌন মহান…। কবির কথা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্য তা টের পেয়েছি জিপে উঠেই। সমবয়সী পাঁচ বন্ধু যে গাড়িতে ওঠি, ওই গাড়ির তো বারোটা বেজে যাওয়ার কথা। চিৎকার-চ্যাঁচামেচি হৈ-হুল্লোড়ে কানঝালাপালা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু একটি শব্দও শুনিনি। নিজেদের মতো গান শুনছে, পাশের যাত্রীর কোনো অসুবিধা হয় এমন আচরণ ভুলে-ভালেও কেউ করল না।
আমরা দু’জন আর ওরা পাঁচজন দার্জিলিংয়ের যাত্রী। একজন ছিলেন কার্শিয়ংয়ের যাত্রী। অজিতকুমার দাস। তিনি বাংলাদেশ থেকে আমাদের সঙ্গেই এসেছেন। টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছে। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই অজিতবাবু নানা গল্প ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে শুরু করেন। অজিতবাবু সঙ্গে থাকায় লাভ হয়েছে এতটুকু, দার্জিলিং পৌঁছার আগেই দার্জিলিংয়ের গল্প-অভিজ্ঞতা শোনা হয়ে গেল।
প্রচণ্ড গরম। গাড়ি ছুটছে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে। শুরুতেই আরেকটি ধাক্কা খেলাম। ভুল বললাম। শিক্ষা পেলাম। দার্জিলিংয়ের দুটো অংশ। সমতলভূমি। এখন যেখানটায় আমরা গাড়ি ছুটিয়ে চলছি। উচ্চভূমি, যেখানটায় আমাদের গন্তব্য। সমতলভূমির পুরোটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, কোয়ার্টার এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বিশাল এলাকাজুড়ে তাদের অবস্থান। মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল চা বাগান। কখনও সখনও ঘন বন। অজিতবাবু বলছিলেন, ভাগ্য ভালো থাকলে পথে হাতির দেখাও পেয়ে যেতে পার তোমরা। রাস্তায় বড় বড় বোর্ডে ইংরেজিতে লেখা, ‘বন্য প্রাণীদের নিরাপদে যেতে দিন’। ভাগ্য আমাদের প্রসন্ন হয়নি। যাওয়ার সময়ও না। আসার সময়ও না। তাই হাতির দেখা পাইনি। তবে আসার সময় একটি বন মোরগ লাফিয়ে আমাদের গাড়িতে এসে পড়ে। প্রথমটায় ভয় পেয়ে যাই। পরে অবশ্য খুব হাসাহাসি হয়েছে এ নিয়ে।
গাড়ি ঢুকে গেল ঘন বনের রাস্তায়। দুই পাশে গভীর বন। মাঝ দিয়ে রাস্তা। এত মনোমুগ্ধকর বলে বোঝাতে পারব না। অজিতবাবু বললেন, দেখ কত বনজ সম্পদ গাছগাছালি পড়ে রয়েছে। পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা-ঘরবাড়ি বানিয়েছে মানুষ, কিন্তু পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট হতে দেয়নি একটুও।
আঁকাবাঁকা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের বিশালতা কখনোই অক্ষরে ফুটিয়ে তোলা যায় না। দু’চোখ যেদিকে যায় পাহাড় আর পাহাড়। মেঘের সঙ্গে মিশে আছে পাহাড়। আকাশের সমান উচ্চতা নিয়েও কী মৌন-নীরব-গম্ভীর হয়ে আছে সে পরিবেশ।
দার্জিলিং ছবির মতো সুন্দর মন ভোলানো শহর। টাইগার হিলের সূর্যোদয়, জুলজিকাল পার্ক, ঘুম বৌদ্ধ মনেস্ট্রিসহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। ওপরে উঠতে উঠতে আকাশের হাতছানি।
দার্জিলিং পৌঁছে কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হল। ঢাকার জুরাইন থেকে গিয়েছেন মিজান ভাই এবং শাহাদাত ভাই। জুলজিকাল পার্ক, রক গার্ডেন, অপূর্ব সুন্দর চা বাগান দেখার পর শাহাদাত ভাই বললেন, মামুন ভাই, এসব তো সুন্দর! কিন্তু পাহাড়ি পথে যে এলাম ওইটাই বোধহয় দার্জিলিংয়ের আসল সৌন্দর্য। আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি উঠছে। আর পাহাড় একটু একটু করে আমার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে। আবার পাহাড়ের গা ঘেঁষে মানুষের বসতি। স্কুল-কলেজ বাজার… অপূর্ব! অসাধারণ! এসব চোখে না দেখলে কখনও বলে বা ছবি দেখে এমনকি ভিডিও দেখেও এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
পুরো ভ্রমণপথ মাতিয়ে রেখেছে নেপালি ড্রাইভার। সাধারণ কথা বলছে, তাতেও যেন রস উপচে পড়ছে। যখন পাহাড়ের কাছাকাছি চলে গেলাম, একটি রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামল। নেপালি ভাষায় বলল, ‘খানাপিনা করে নাও।’ দার্জিলিংয়ের মানুষ বেশিরভাগই নেপালি ভাষায় কথা বলে। বাংলাও বোঝে। ব্রিটিশদেরও আগে দার্জিলিংয়ের একাংশ নেপাল শাসিত ছিল। সম্ভবত এখানে নেপালিদের পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল। অধিকাংশ মানুষ দেখতে হুবহু নেপালিদের মতো। কথাও বলে নেপালি ভাষায়। জিজ্ঞেস করলে বলে, আমরা ভারতীয়!
গাড়ি চলছে, দুপুরের খাবার দার্জিলিং গিয়ে খাব, তাই হালকা কিছু খাবারের জন্য ভেজিটেবল মমো দিতে বললাম। ভেতরে সবজি দিয়ে ওপরে পিঠার মতো। তবে পুরোটাই সেদ্ধ। খুব অনিচ্ছা নিয়ে মুখে দিতেই মনে হল অমৃত মুখে দিয়েছি। বেশ সুস্বাদু। খেলামও মজা করে। পরের দিন যখন জুলজিকাল পার্কে আবার মমো খেলাম তখন মিজান ভাইকে বললাম, সেম জিনিসটাই আমরা পোড়া তেলে ভেজে একেবারে অস্বাস্থ্যকর করে খাই। অথচ এভাবে খাওয়া কতটা স্বাস্থ্যকর! অবশ্য অজিতবাবু আগেই বলে দিয়েছেন, দার্জিলিংয়ে তুমি ভেজাল কিছু পাবে না। গাড়ি ছুটছে। আরও ঘণ্টা দুই চলার পর কার্শিয়ং স্টেশনে গিয়ে থামল। এবার একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে।
গাড়ি করে যতই ওপরে উঠছি, ততই আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একটু পর পর মনে হল দার্জিলিং বুঝি এসেই পড়েছে, পাশেরজনকে জিজ্ঞেস করলাম আর কতক্ষণ, তিনি বললেন আরও দেড় ঘণ্টা। নতুন যারা দার্জিলিং আসে, তাদের অবস্থা এমনই হয়। এভাবে চার ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা সত্যি সত্যিই দার্জিলিং এসে পৌঁছলাম। দার্জিলিং আমাদের বৃষ্টি ঝরিয়ে রোদ ঢেলে অভিবাদন জানাল।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
alfatahmamun@gmail.com