আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, থাকুক আমাদেরই
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৩০:৩২,অপরাহ্ন ০২ মে ২০২০ | সংবাদটি ৫৫৬ বার পঠিত
মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা
দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের নিকট পরম আরাধ্য একটি পর্যটন গন্তব্য হচ্ছে আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ যা নারিকেল জিঞ্জিরা হিসাবেও পরিচিত। বর্তমানে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নামেও এর পরিচিতি বাড়ছে।
এর চতুর্পাশে সাগর আর আকাশের নীল মিলেমিশে একাকার।সারি সারি নারিকেল গাছ,কেয়া বন আর সাগরলতার মায়াময় স্নিগ্ধতায় মন জুড়িয়ে যায় নিমিষেই।
ভাটায় জেগে ওঠা নান্দনিক প্রবাল প্রাচীর, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা গাঙচিল, পশ্চিম বিচ থেকে দেখা সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য, সৈকতে বসে নরম কোমল স্নিগ্ধ বাতাসে গা জুড়িয়ে নেয়া, অগভীর সাগরের স্বচ্ছ নীল জলে দল বেঁধে বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠার লোভে প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে প্রায় ১ মিলিয়ন পর্যটক পদচিহ্ন আঁকেন স্বপ্নের দারুচিনি দ্বীপে।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ‘বদর মোকাম’ থেকে ৯ কিলোমিটার এবং টেকনাফ থানা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মায়ানমার উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত এই দ্বীপ।
উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যে ভরপুর এই দ্বীপে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক – ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তবীজী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ও ১২০ প্রজাতির পাখি ও ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া নারিকেল গাছ ও কেয়া বন ছাড়াও সেখানে বাইন, শেওড়া, কেওড়া ও কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ দেখা যায়।
৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপটি উত্তর দক্ষিণে ৫.৬৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং পূর্ব পশ্চিমে গড়ে প্রায় .৫ কিলোমিটার প্রস্থ। সমুদ্র সমতল থেকে এর উচ্চতা ৩.৬ মিটার। দ্বীপের সর্ব দক্ষিণে প্রায় ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের পৃথক আরেকটি দ্বীপ আছে যা ছেঁড়া দ্বীপ নামে পরিচিত। ছেঁড়া দ্বীপে কোনো লোক বসতি নেই। মূল দ্বীপের সাথে এর সংযোগস্থল (স্থানীয়ভাবে গলাচিপা নামে পরিচিত) সামান্য নিচু হওয়ায় জোয়ারের সময় এটি তলিয়ে যায়। তাই ভাটার সময় হেঁটে ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়া গেলেও জোয়ারের সময় নৌকা নিয়ে যেতে হয়। জোয়ার থাকা কালীন ছেঁড়া দ্বীপে দাঁড়ালে ভয়ে গা ছমছম করে উঠে। সেন্টমার্টিন গিয়ে ছেঁড়া দ্বীপ না গেলে ভ্রমণের ১২ আনাই বৃথা। সবচেয়ে ভালো হয় উত্তর প্রান্ত থেকে পশ্চিম বিচ ধরে সম্পূর্ণ পথ পায়ে হেঁটে গেলে।নির্জন এই পথটা অসম্ভব সুন্দর। এমন রোমাঞ্চকর ভ্রমণের কথা জীবনে কখনো ভুলা যাবে না।
সেন্টমার্টিনের প্রায় ৭৩০০ জন স্থানীয় অধিবাসীর জীবন-জীবীকা মৎস আহরণ, শুটকি প্রকৃয়াকরণ, সামান্য চাষাবাদ ও পর্যটন সেবার উপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে (অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত) দ্বীপটি কর্মচঞ্চল থাকে। শতাধিক হোটেল, মোটেল রেস্তোরায় চলে পর্যটক আকর্ষণের নানান আয়োজন। সন্ধ্যা বেলা হোটেল রেস্তোরার সামনে পথের দুধারে, সৈকতের পাশে নানা পদের মাছ, কাঁকড়া, অক্টোপাসের পসার সাজিয়ে বসে দোকানীরা। তেলে ভাজা মাছের সুগন্ধে চারদিক মৌ মৌ করে। রাতে প্রায় সব হোটেলের আঙিনায় চলে মাছের বার্বিকিউ উৎসব। নাচে গানে আনন্দ আড্ডায় অপূর্ব সময় কাটে।
পর্যটন মৌসুমে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যাত্রী পারাপারে ৬/৭টি জাহাজ চালু থাকে। এগুলোর মধ্যে কেয়ারি সিন্দাবাদ, কেয়ারি ক্রুজ এন্ড ডাইন, এলসিটি কুতুবদিয়া, বে ক্রুজ, কাজল ও গ্রিন লাইন উল্লেখযোগ্য।
পরিতাপের বিষয় সম্প্রতি জীববৈচিত্র্য রক্ষার নামে সেন্টমার্টিনে পর্যটক উপস্থিতি কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। দেশে পর্যটন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন নামে একটি সংস্থা থাকার পরও কীভাবে এমন হটকারী একটি সিদ্ধান্ত হলো তা বোধগম্য নয়। পৃথিবীর কোথাও এমন অজুহাতে কোন প্রবাল দ্বীপে পর্যটন বাধাগ্রস্ত হয়নি। প্রবাল প্রাচীর বা প্রবাল দ্বীপ পর্যটন শিল্পের অত্যন্ত দামি পণ্য হিসাবে দুনিয়াজুড়ে স্বীকৃত। অস্ট্রেলিয়া গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ (ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসাবে স্বীকৃত) থেকে বছরে ৫.৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে। প্রবাল দ্বীপ হিসাবে পরিচিত মালদ্বীপের মোট দেশজ উৎপাদনের ২৩ ভাগ এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৮০ ভাগ পর্যটন থেকে আসে। এছাড়া ফ্লোরিডা, বাহামা, মেক্সিকো, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া তাদের প্রবাল দ্বীপগুলোকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে কারি কারি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প হিসাবে পরিগণিত। ২০১৭ সালে গ্লোবাল জিডিপি তে পর্যটন খাতের হিস্যা ছিলো ১০ ভাগ। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০০ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই শিল্পে যা মোট কর্মসংস্থানের ১০ ভাগ। বাংলাদেশের জিডিপি তে পর্যটন খাতের অবদান মাত্র প্রায় ৪ ভাগ। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নানামুখী সমস্যার অতলান্তে নিমজ্জমান।
অনিন্দ্যসুন্দর রূপের দেশ বাংলাদেশ।পর্যটন শিল্প বিকাশের অপার সম্ভাবনাকে কোনো কারণেই সংকুচিত করা ঠিক হবে না। সেন্টমার্টিন ছাড়াও এদেশে আরো ৫৫/৬০টির মতো দ্বীপ আছে। সেন্টমার্টিনকে পর্যটনের জন্য ছেড়ে দিয়ে বাকি দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মনোনিবেশ করা উচিত।
সেন্টমার্টিনকে পর্যটন বান্ধব করতে মালদ্বীপের ‘মাফুশি’ দ্বীপের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। যেখানে সেখানে মানহীন হোটেল মোটেল না করে একটি মাস্টার প্ল্যানের আওতায় আধুনিক সুবিধাসহ মানসম্মতভাবে সেসব করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে পুরো দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে ছোট আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে। যাতায়াতের জন্য অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো পাকা করার ব্যবস্থা করে আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ও রিসাইক্লিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাহিনী থাকবে যাদের নিয়মিত পরিচর্যায় দ্বীপের প্রতিটি সকাল হবে ঝকঝকে পরিপাটি। সর্বোপরি দ্বীপটিকে পর্যটকদের নিকট নিরাপদ ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
এসবের জন্য অর্থায়নে পর্যটকদের উপর গ্রিন ট্যাক্স আরোপ করা যেতে পারে। দ্বীপের বার্ষিক উন্নয়ন ও চলতি ব্যয়ানুপাতে প্রয়োজনীয় আয়ের লক্ষ্যে ট্যাক্সের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।এর ফলে অবকাশ যাপনে দেশি বিদেশি পর্যটকদের নিকট আদর্শ গন্তব্য হয়ে উঠবে আমাদের সেন্টমার্টিন দ্বীপ।এতে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও জিডিপি তে পর্যটন শিল্পের অবদান বাড়বে বৈকি।
লেখক : শিক্ষক, লেখক ও গীতিকবি।