বরিস জনসনের চিঠি
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৫৩:৪৩,অপরাহ্ন ১২ এপ্রিল ২০২০ | সংবাদটি ২৫০ বার পঠিত
তাইসির মাহমুদ
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাকে এখন সাধারণ ওয়ার্ডে নেয়া হয়েছে। তিনি বিছানায় উঠে বসতে পারছেন।
ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলছেন। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। তাকে নিয়ে ব্রিটেনবাসী দুশ্চিন্তায় ছিল। আমিও ছিলাম। কারণ ইতঃপূর্বে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত হলেও গত কয়েক মাসে কিছু ভালো কাজ করতে পেরেছেন।
ব্রেক্সিট নামক গলার কাঁটাটি তিনিই আপাতত ব্রিটেনের সাড়ে ৬ কোটি মানুষের গলা থেকে সরাতে পেরেছেন। আর অতি সম্প্রতি করোনার ভয়াবহ বিস্তারে যখন গোটা দেশবাসী শঙ্কিত, তখন তিনি তার তেজোদীপ্ত কথাবার্তা দিয়ে মানুষকে কিছুটা হলেও সাহস জোগাতে পেরেছিলেন।
ব্রিটেন ও ব্রিটেনবাসীর স্বার্থে তার এ মুহূর্তে সেরে ওঠা খুবই জরুরি। দেশবাসী আশাবাদী তিনি সেরে উঠবেন। শিগগিরই ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে যাবেন। আবার টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলবেন, ‘স্টে অ্যাট হোম, প্রটেক্ট দ্য এনএইচএস অ্যান্ড সেইভ লাইভস।’
৫৮ লাখ পাউন্ড (৫৮ কোটি টাকা) ব্যয়ে তিনি ৩ কোটি ব্রিটেনবাসীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার দিন কয়েক আগে। সেই চিঠিটি বিলম্বে হলেও গত বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) আমার লেটার বক্সে ছেড়ে গেছে ডাকপিয়ন।
যদিও ইতোমধ্যে চিঠিটির ডিজিটাল কপি ফেসবুকে দেখেছি; কিন্তু পুরোপুরি পড়া হয়নি। চিঠিটি হাতে নিয়ে বেশ আগ্রহের সঙ্গেই লাইন-বাই-লাইন পড়লাম। চিঠির ভাষা ও শব্দচয়ন চমৎকার মনে হয়েছে। চিঠির সঙ্গে চার পৃষ্ঠার একটি বুকলেটও পেলাম। যেখানে করোনাকালীন সতর্কতাবলি এবং কী কী সরকারি সুবিধা আছে, তা কীভাবে পাওয়া যেতে পারে- এসব সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে।
আগে ভেবেছিলাম, এত পয়সা খরচ করে চিঠি না পাঠিয়ে তিনি যা বলতে চাচ্ছেন তা প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বলে দিলেই পারতেন। কিন্তু আজ মনে হল চিঠি লেখাই ভালো হয়েছে। কারণ দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে কোনো নাগরিকের চিঠি পাওয়া বেশ সম্মানের বিষয়।
ব্রিটেনে ১৭ বছরের জীবনে একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে (সাংবাদিক হিসেবে নয়) এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। এটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। যারাই চিঠিটি পেয়েছেন, তাদেরও একই অনুভূতি হওয়ার কথা। এটিই চিঠির একটি বড় সার্থকতা।
দেড় পৃষ্ঠার চিঠিতে তিনি যে বিষয়টিতে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন তা হচ্ছে ‘স্টে হোম’ বা ঘরে অবস্থান করুন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়ার সতর্কবার্তাা। তবে মানুষের ব্যক্তি, সামাজিক ও কর্মজীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টির বিষয়টি নিয়েও নিজের উপলব্ধির কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
আর দেশের নাগরিকদের কী কী সুবিধা দেবেন, তা-ও উল্লেখ করে আশ্বস্ত করেছেন। এসবের মধ্যে আছে ছোট, বড় ও মাঝারি সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩৩০ বিলিয়ন পাউন্ড ঋণ বরাদ্দ। ২০ বিলিয়ন পাউন্ড সমমানের ট্যাক্স মওকুফ ও নগদ সাহায্য প্রদান। তিন মাসের জন্য ভিএটি পরিশোধ বিলম্বিতকরণ।
চাকরিজীবীদের বেতনের ৮০ শতাংশ সরকার থেকে দেয়া। অর্থাৎ কোনো নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠান লকডাউনের কারণে বেতন দিতে না চাইলে সরকার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন দেবে; যা হবে জনপ্রতি সর্বোচ্চ আড়াই হাজার পাউন্ড (আড়াই লাখ টাকা) পর্যন্ত।
যারা চাকরি করেন না, নিজের কাজ নিজে করেন, অর্থাৎ সেলফ এমপ্লয়েড, তাদেরকে আয়ের লভ্যাংশের ওপর তিন মাস পর্যন্ত মাসিক ৮০ শতাংশ করে ভাতা দেয়া হবে। তারাও সর্বোচ্চ আড়াই হাজার পাউন্ড করে পাবেন।
যারা কর্মহীন অথবা কম বেতনে চাকরি করেন, তাদেরকে ইউনিভার্সেল ক্রেটিড এবং ট্যাক্স ক্রেডিটের মাধ্যমে সহায়তা দেবেন, যা মাসিক সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। যারা ভাড়া করা বাড়িতে থাকেন তাদের সাহায্যে আর ১ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছেন। আর বাড়ির মালিকদের মধ্যে যারা মাসিক মর্গেজ বা লোনের কিস্তি পরিশোধে অক্ষম, তাদের জন্য তিন মাসের ‘মর্গেজ হলিডে’ ঘোষণা করেছেন।
চিঠিটি পড়ে অনেক তথ্য পেলাম। কিছু ক্ষেত্রে আশ্বস্তও হলাম। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে চিঠির একটি বিষয় আমার কাছে খুব ভালো লাগল। চিঠিটির ভাষা একেবারে সাবলীল ও সাদামাটা। এতে মহামারী ঠেকাতে তার কোনো সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনার ঘোষণা নেই।
নিজের দল ও দলের নেতাকর্মীদের গুণকীর্তন নেই। ব্যক্তিগত কিংবা সরকারের সাফল্যের কোনো ফিরিস্তি নেই। সাদা কাগজে লেখা চিঠির উপরে শুধু প্রধানমন্ত্রীর অফিসের লোগো ও ঠিকানা এবং নিচে একটি স্বাক্ষর। লেটারহেডে তার কোনো ছবি নেই। শুধু ‘ঘরে থাকুন, ভালো থাকুন, এনএইচএসকে বাঁচিয়ে রাখুন’- এ বার্তাটিই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে।
তাইসির মাহমুদ : সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য