রমজান, নাকি রামাদান?
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:১০:২২,অপরাহ্ন ৩১ মে ২০১৯ | সংবাদটি ৩৫০ বার পঠিত
মো. মাকসুদুর রহমান
সিয়াম সাধনার মাস রমজান, না রামাদান? বাংলা ভাষায় দুটি শব্দেরই প্রচলন রয়েছে। তবে রামাদানের তুলনায় রমজান অনেক বেশি প্রচলিত ও প্রবল। রামাদান শব্দটির ব্যবহার কিছুটা নতুন। প্রচলিত দুটি শব্দের কোনটি শুদ্ধ? রমজান, না রামাদান? রমজানের পরিবর্তে রামাদান ব্যবহারেরই বা যুক্তি কী? সম্প্রতি বিবিসি বাংলায় এ সম্পর্কে “‘রমজান’ কিভাবে ‘রামাদান’ হয়ে উঠেছে ভারতে” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে ভারতবর্ষে রমজান শব্দের উৎস ও প্রচলনের কারণ তুলে ধরার পাশাপাশি ‘রামাদান’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার যুক্তিগুলোও পেশ করা হয়েছে। প্রতিবেদক এ ক্ষেত্রে একাধিক লেখক, ইতিহাসবিদ ও আলেমের মতামত নিয়েছেন। তাঁরা রামাদান লেখার প্রবণতা তৈরির পেছনে আরবভূমির সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ বৃদ্ধি, শিক্ষাসচেতনতা ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ, তথা শুদ্ধিকরণের প্রবণতা তৈরিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতামত থেকে এটাকে ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তনের অংশ বলেই মনে হয়।
কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন কলাম লেখক তাঁর লেখায় রামাদান লেখার প্রবণতা ওয়াহাবিজম প্রতিষ্ঠা, আমেরিকার সহযোগিতায় সৌদি আরবের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মতানৈক্য শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত করার জন্য আরবীয় ওয়াহাবিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তার মিত্ররা। নানা কৌশলে মুসলিম দেশগুলোতে তারা ওয়াহাবিবাদী তত্ত্ব প্রচারে কোটি কোটি টাকা ঢালতে শুরু করে।’
তিনি আরো লেখেন, ‘এই সময়ই শুরু হয় দোয়াল্লিন-জোয়াল্লিন, রমজান-রামাদান, কোরান-কোরআন, শবেবরাত পালন হালাল না হারাম, মা-বাবা বা মুরব্বিদের পা ধরে সালাম করা হালাল না হারাম ইত্যাদি বিতর্ক। এই বিতর্কের এক পক্ষে পারস্যের সুফিবাদ ও ভারতীয় মরমিবাদ প্রভাবিত আলেমসমাজ, আরেক পক্ষে সৌদি আরবের ওয়াহাবিবাদ প্রভাবিত আলেমসমাজ।’ (বাঙালীয়ানা, ৮ মে ২০১৯)
কোনো সন্দেহ নেই, বাঙালি মুসলিম সমাজে রমজান শব্দটি বেশি ব্যবহৃত। আবহমান কাল থেকে বাঙালি মুসলিমরা তা ব্যবহার করে আসছে। ভারতীয় মুসলিম সমাজে চর্চিত আরবি ও ফারসি ভাষার প্রভাবেই হয়তো তারা আরবি ‘রামাদান’কে রমজান উচ্চারণ করে থাকে। ভাষার স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতির বিচারেও ‘রামাদান’ শব্দটি ‘রমজানে’ রূপ নেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। পৃথিবীর সব ভাষায় নিজস্ব গতি-প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে বিদেশি শব্দ আত্মস্থ করে। সেই হিসেবে ‘রমজান’কে রামাদানের বাংলা রূপ বলা যেতে পারে এবং সেটা অবশ্যই অশুদ্ধ নয়। তবে কেউ যদি বিদেশি শব্দের বিশুদ্ধ উচ্চারণে আগ্রহী হয় তাহলে সেটাকে আগ্রাসন বলার সুযোগ কতটুকু? বিশেষত সেটা যদি কোরআনের শব্দ হয়, যার বিশুদ্ধ উচ্চারণের তাগিদ কোরআন ও হাদিসে রয়েছে। যেমন—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কোরআন তিলাওয়াত করো আরবদের সুর ও উচ্চারণ অনুসারে।’ (বায়হাকি, হাদিস : ২৪০৬)
সুতরাং কেউ যদি কোরআনে ব্যবহৃত শব্দসমূহের বিশুদ্ধ উচ্চারণের দাবি করে, তা অবশ্যই সম্মানযোগ্য। শুধু আরবি ভাষাই নয়, বরং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে শুদ্ধিকরণের প্রবণতা এখন প্রবল। তারা বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দেরও বিশুদ্ধ ব্রিটিশ উচ্চারণে যত্নবান। তাদের এই প্রচেষ্টা ক্ষেত্রবিশেষে প্রশংসিতও।
দ্বিতীয় কথা হলো, রমজান ও রামাদান নিয়ে আলেমসমাজের মতভিন্নতা রয়েছে ঠিক, তবে তা অবশ্যই বিতর্ক ও মতানৈক্যের পর্যায়ে নয়। কেউ মনে করেন, বাঙালি সমাজে প্রচলিত ও সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া রমজান শব্দ ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। আর কেউ কেউ মনে করেন, কোরআনে ব্যবহৃত শব্দটির আরবি উচ্চারণই উত্তম। এর বাইরে বড় ধরনের কোনো বিবাদ আলেমসমাজে নেই।
লেখক তাঁর লেখার শেষে লিখেছেন, ‘ভাষারও রাজনীতি আছে, ভাষারও সংস্কৃতি আছে। কোনো জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য ভাষা ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি সবচেয়ে ধারালো হাতিয়ার।’ লেখকের এই বক্তব্যের সঙ্গে শিক্ষিত-সচেতন ব্যক্তি মাত্রই একমত হবেন। তবে ভাষা-সচেতন ও ভাষাকর্মীদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আবহমান কাল থেকে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত লাশ শব্দের পরিবর্তে মরদেহ, ইন্তেকালের পরিবর্তে পরলোকগমন বা প্রাণনাশ, দাউদ (আ.)-এর পরিবর্তে ডেভিড ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারের প্রতিও যেন তাঁরা মনোযোগী হন। নতুবা ভাষার প্রতি তাঁদের এই মমতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
লেখক : প্রভাষক, আল হাদিস বিভাগ, খুলনা কামিল মাদরাসা, খুলনা