সবাইকে কাঁদিয়ে চিরনিদ্রায় জায়ান
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২১:৪৭,অপরাহ্ন ২৫ এপ্রিল ২০১৯ | সংবাদটি ৪০৬ বার পঠিত
শ্রীলংকায় ভয়াবহ বোমা হামলায় নিহত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি জায়ান চৌধুরীর (৮) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার বাদ আসর বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি মাঠে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
মা আমেনা সুলতানা সোনিয়া, বাবা মশিউল হক প্রিন্স ও ছোট ভাই জোহানের সঙ্গে শ্রীলংকায় বেড়াতে গিয়েছিল জায়ান। সেখানেই সন্ত্রাসবাদের শিকার হয় ছোট্ট শিশুটি। পৃথিবীর উগ্র নিষ্ঠুরতায় নিজের জীবন দিয়ে নিষ্পাপ শিশু জায়ান বিশ্ববাসীর জন্য রেখে গেল বেদনার এক নীল সিন্ধু। গুরুতর আহত হয়ে তার বাবা এখনও সেখানকার একটি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তার পাশে থাকতে হয়েছে মা সোনিয়াকেও। তাই বাবা-মাকে রেখেই শেষ যাত্রায় দেশে ফিরতে হল আদরের জায়ানকে।
জায়ানের মরদেহ বহনকারী শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের ইউএল-১৮৯ ফ্লাইটটি দুপুর পৌনে ১টায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। মরদেহের সঙ্গে জায়ানের নানি (শেখ সেলিমের স্ত্রী), দুই মামা শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাঈম এবং ভাই জোহান দেশে ফেরে। বিমানবন্দরের টারমার্কে নাতি জায়ানের মরদেহ গ্রহণ করেন শেখ সেলিম। এ সময় তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ এবং দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ।বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে দুপুর দেড়টায় জায়ানের মরদেহ বহনকারী গাড়ি শেখ সেলিমের বনানীর বাসায় পৌঁছে। কয়েকদিন আগে যে বাড়ি থেকে দুরন্ত জায়ান বাবা-মা ও ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়েছিল বেড়াতে। বাবা-মাকে হাজার মাইল দূরে রেখে লাশের গাড়িতে করে সেই বাড়িতে শেষবারের মতো এলে সেখানে সৃষ্টি হয় শোকাবহ পরিবেশের। কান্নায় ভেঙে পড়েন উপস্থিত সবাই। নানা কথায় আফসোস করতে থাকেন তার প্রিয় ক্রিকেটের সঙ্গীরা।
এদিকে প্রিয় নাতি জায়ান চৌধুরীকে শেষবারের মতো দেখতে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে বনানীতে জায়ানের নানা ফুপাত ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বাসায় যান তিনি। এর আগে শেখ সেলিমের বাসায় জায়ানকে শেষবারের জন্য দেখতে আসেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
খেলার মাঠেই শেষ বিদায় : প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার কিছু সময় পরেই বনানীর ২ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়ি থেকে শেষবারের মতো নিয়ে আসা হয় শিশু জায়ানকে। এই নানাবাড়িতেই বেড়ে উঠছিল সবার আদরের জায়ান। পাশেই চেয়ারম্যান বাড়ি মাঠ। যে মাঠে ব্যাট-বল হাতে ছুটে বেড়াত ছোট্ট জায়ান। সেই মাঠেই বুধবার আয়োজন করা হয় তার শেষ বিদায়ের। প্রস্তুত করা হয় মঞ্চ। টানানো হয় প্যান্ডেল। নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রবেশের জন্য তিন গেটেই রাখা ছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি ব্যবস্থা। পাশাপাশি মানুষের সমাগমের কথা মাথায় রেখে জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
এদিকে দুপুরের পর থেকেই সেই মাঠে অশ্রুজলে অপেক্ষা হাজারও শুভাকাক্সক্ষীর। বিকাল ৪টা ৫ মিনিটে মাঠে নিয়ে আসা হয় জায়ানের মরদেহ। ততক্ষণে মাঠ প্রায় পূর্ণ। জায়ানের মরদেহ মাঠে নিয়ে আসার পরে সবার দেখার সুবিধার্থে মাঠের চারপাশে লাগানো স্ক্রিনে তার চেহারা দেখানো হয়। আদুরে এই শিশুটির নিশ্চুপ মুখখানি দেখে এ সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন উপস্থিত সবাই। চোখের পানি মুছতে দেখা যায় অনেককেই। ৫টা ১৮ মিনিটে সেখানে তার জানাজা সম্পন্ন হয়।
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সাবেক চিপ হুইপ আবুল হাসানত আবদুল্লাহ এমপি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু, লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্ববি মিয়া, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক নৌপ?রিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, শেখ ফজলে নূর তাপস এমপি, আকবর খান পাঠান এমপি, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।
জানাজা পড়ানোর আগে শেখ সেলিম নাতি জায়ান এবং তার আহত বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চান। এ সময় তিনি জায়ানের মৃত্যুতে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে থাকার জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আপনারা সবাই দোয়া করবেন আমার মেয়ে যেন এই শোক সহ্য করতে পারে। আমার জামাই যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। শেখ সেলিম আরও বলেন, ১৫ আগস্ট যারা শহীদ হয়েছেন, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় নেয়া হয়েছে। বাকি ১৮ জনকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই ১৮ জনের সঙ্গেই ১৯তম শহীদ হিসেবে জায়ানকে সেখানে দাফন করা হবে। আগামী শনিবার এই মাঠেই জায়ানের কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান তিনি।
ইস্টার সানডের প্রার্থনার মধ্যে রোববার গির্জা ও হোটেল মিলিয়ে আটটি স্থানে বোমা হামলায় রক্তাক্ত হয় শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বো। এর মধ্যে একটি হোটেলে উঠেছিল জায়ান ও তার পরিবার। হামলার সময় হোটেলের নিচতলার রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা করতে গিয়েছিলেন জায়ান ও তার বাবা। ছোট ভাই জোহানকে নিয়ে মা শেখ সোনিয়া ওই সময় হোটেলের কক্ষে ছিলেন। এই হামলায় প্রাণ হারায় জায়ান। গুরুতর আহত হয়েছে তার বাবা। তার লিভারে বোমার স্পিন্টার পাওয়া গেছে। স্টমাক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এখন তিনি আইসিইউতে।
জায়ানের মৃত্যুতে বিএনপির শোক : এদিকে জায়ান চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে শোক প্রকাশ করে বলেন, শ্রীলংকার বোমা হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি মারা গেছেন। বিশেষ করে শিশু জায়ান চৌধুরী। এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তারসহ বাংলাদেশি অন্য যারা মারা গেছেন এবং আরও যারা বিদেশি আছেন, সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
একই সঙ্গে জায়ান চৌধুরীসহ অন্যদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে রিজভী বলেন, আমরা তাদের পরিবার-পরিজনকে সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আমাদের বাংলাদেশি যারা আহত হয়েছেন তাদের সুস্থতা কামনা করছি। সৌজন্য – যুগান্তর